এর পর কালো-মাস্টার আর কোনো আপত্তিই করল না। কিন্তু আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল– কোত্থেকে-না আবার কোন নতুন বিপদ হয়! মনে হতে লাগল, এতে কেমন যেন বিশেকে ছোটো করা হচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কালো-মাস্টারও খুব খুশি, ওকে নিয়ে আর আমাকেও ভাবতে হবে না, আমার পেরিস্তানও নিরাপদ।
কালো-মাস্টার আরও বললে, একটু বেশি রাত করে আসব, স্যার, তা হলে! এই চাতাল দিয়ে ঘুরে আসব, আপনি লাইব্রেরি ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে রেখে শুয়ে পড়বেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর টর্চ নিয়ে গেলাম একবার পেরিস্তানে। কালো-মাস্টার আমাকে দেখে চমকে-টমকে একাকার। বললাম, আবার এখানে এলে কেন। থেকে গেলেই পারতে।
কালো-মাস্টার বললে, না কত্তা, এসেছি ভালোই করেছি। নৌকোটাকে তো ঝোঁপের পেছনে ফেলে রাখা যায় না। এখানে রাখাও ঠিক নয়, তাই লুকিয়েছি কারখানা বাড়ির ঘাটের নীচের আড়ালে। তা ছাড়া
–কী তা ছাড়া?
–তা ছাড়া আজ বোধ হয় বিকেলে তোমার সত্যিকার বিশে তার সিংহকে নিয়ে এসে থাকবে।
আমি এমনি চমকে গেলাম যে আর-একটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম। বললাম, অসম্ভব, বিশে আসতেই পারে না!
কালো-মাস্টার কোনো কথা না বলে, আমার হাতের টর্চটা নিয়ে সিঁড়ির ধাপের কাছে মাটির ওপর আলো ফেলল। দেখলাম বড়ো বড়ো থাবার দাগ। সঙ্গে মানুষের জুতোপরা পায়ের ছাপও আছে। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল।
–তুমি কোনো জিনিসপত্র এখানে ফেলে রাখনি তো, কালো-মাস্টার?
কালো-মাস্টার বললে, খেপেছ? তাপ্পর তাই দেখে আমার সন্ধান পাক আর কী! আমার থাকবার মধ্যে ছিল তো ওই দাড়ি-গোঁফ, সেও তোমার ছোটকার কাছে সঁপে দিয়েছি। দেখতে পার, তোমার চোরা ঘর খাঁ-খাঁ করছে, তোমার ওই জলের বোতল আর খাবারের টিন ছাড়া কোত্থাও কিচ্ছু নেই। এখানে খুঁজলে কালো-মাস্টারের চিহ্নটুকু পাওয়া যাবে না। তুমি এবার যাও দিকিনি ঘরে, আমিও অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে তোমাদের লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে সেঁদোই। ও-রকম কালো মুখ কেন গা? একটু আনন্দ করো, এই দেখো কেমন তোমার পেরিস্তান ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি। আমারই জন্য তোমার বন্ধু বিশে আসে না, সে কি আমি বুঝিনি ভেবেছ? এবার তাকে খবর দাও, সে এসে দেখে যাক পেরিস্তানের এতটুকু ক্ষতি করিনি।
কালো-মাস্টারের দেখি মহাফুর্তি, থাবার দাগ আমাকে একবার দেখিয়েই সে-বিষয় ভুলে গেছে, আমার কিন্তু আত্মাপাখি খাঁচাছাড়া। ও কথাটা বিভুদার কাছে শেখা। খালি মনে হতে লাগল কোথাও একটা গলদ থেকে যাচ্ছে, তাই থেকে এখনও অনেক বিপদের সম্ভাবনা আছে।
উপরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কালো-মাস্টারও ভাটার কাদা ভেঙে নদীর ধার দিয়ে রওনা দিল। ওকে নিয়ে আর আমার কোনো ভাবনাই রইল না। কেবলই বড়ো বড়ো থাবার দাগের কথা মনে হতে লাগল। ও যে সিংহের থাবা হতে পারে না সে আমি জানতাম… তবে কার?
হঠাৎ চমকে উঠে বসলাম। যদি পুলিশের ডালকুত্তোর হয়? যদি কালো-মাস্টারের শত্রুরা ওর পেছনে ডালকুত্তো লাগিয়ে থাকে? আবার শুলাম… তাও তো হবার জো নেই, জলের ওপর দিয়ে শুকে শুকে কুকুর তো আসতে পারে না! আমি জলে নামি না বটে, মা-বাবা বলেন জলে নামলে গায়ে ঠান্ডা লেগে আমার সর্দি হবে, সেই সর্দি বুকে বসে আমার নিউমোনিয়া হবে। কিন্তু বিশেদের ছোটো ছেলেরা হাঁটা শেখার আগেই নাকি সাঁতার শেখে। দেশ জুড়ে গায়ের শিরার মতো সুন্দর সুন্দর সব নদী, তাতে ওরা দিনরাত হেঁটে বেড়ায় পথঘাটের চেয়ে নদীর জলে হাঁটতেই ওদের সুবিধে লাগে। ওদের পেছনে কেউ ডালকুত্তো লাগালেও ওদের ধরতে পারে না। জল পেলেই ওরা জলে নেমে পড়ে, জলের ওপর দিয়ে ডালকুত্তো ওদের গন্ধ পায় না।
শুঁকে শুঁকে কারো খোঁজে ডালকুত্তো পেরিস্তানে আসেনি। পেরিস্তানের গন্ধই আলাদা। ওর শব্দও আলাদা, মানুষের গলার স্বর নেই ওখানে, খালি নদীর কলকল, ছলছল, মাঝে মাঝে দাঁড় বাইবার ছপাত ছপাত, আর দূরে পুলের ওপর থেকে টং লিং টং লিং টং লিং।
এখন আমার ঘর থেকেও শুনতে পেলাম টং লিং টং লিং টং লিং কোনো ভয় নেই, কোনো ভয় নেই।
১১-১২. সত্যি সত্যি নাটক হবে
এতদিনে সবার মনে হতে লাগল যে শেষপর্যন্ত সত্যি সত্যি নাটক হবে। কারো মনে এখন আর কোনো ভাবনা নেই; শিশুপালের মতো শিশুপাল এসেছে, বর্ম-অস্ত্র পরালে কে চিনবে কালো-মাস্টারকে! তার ওপরে যখন সবচেয়ে ভালো কোঁকড়া চুলটা আর পাকানো গোঁফটা পরে সেজেগুঁজে লাইব্রেরি ঘরে রিহার্সালের পর এসে ছোটকার আর আমার সামনে দাঁড়াল, আমরা তো হাঁ! কী-একটা রাজা রাজা ভাব, কে বলবে সত্যিকার শিশুপাল নয়।
সত্যি কথা বলব? স্বয়ং বিশেও যে এর চেয়ে ভালো পার্ট করতে পারত এ আমার এখনও মনে হয় না। এর চেয়ে বেশি আর কী বলতে পারি? আর সে দাড়ি-গোঁফেরও তুলনা হয় না। ছোটকা বললেন, বিশু, আমার চৌত্রিশ বছর বয়স, তার মধ্যে কুড়ি বছর ধরে প্রত্যেক পুজোয় নাটক করেছি, নাটক দেখেছি, কিন্তু দাড়ি-গোঁফের এমন বাহার আমি কল্পনাও করতে পারিনি!
ইস, ছোটকা বেচারা যে এতটা বুড়ো তা আমি জানতাম না। এদিকে ফুর্তির চোটে সক্কলের। পার্ট মুখস্থ হয়ে গেল, ঝগড়াঝাটি বন্ধ হয়ে গেল। এমনকী বিভুদা আমাকে আর একদিনও মারেনি। অবিশ্যি সব সময় কালো-মাস্টার কাছে কাছে থাকত বলেও সেটা হতে পারে।