আমি বললাম, তাহলে আমাদের লুকোনো ঘরের কথা ওকে জানিয়েছ, পেরিস্তানের কথাও বলেছ?
কালো-মাস্টার যেন আকাশ থেকে পড়ল। আচ্ছা, আমাকে কী ভাব বলো দিকিনি কত্তা? তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ, আমি কখনো অমন কাজ কত্তে পারি? তোমার কোনো ভয় নেই, ওকে বলেছি– আমি কারখানা-বাড়ির পাহারাওয়ালা, দিনরাত আমার ডিউটি থাকে, তাই খাবার কেনবার সময় পাই না। সারাটা জীবন বুদ্ধি ভেজে খেইছি, আর এখন একটা বাইরের লোকের কাছে সব ভেস্তে দোব! আমি সে ছেলে নই!
শুনে আমি অবাক!
–কিন্তু এরই মধ্যে এত কথা হয়ে গেছে?
–আরে শুধু কি তাই? ও আমার জিনিসপত্তর যখন যা দরকার কিনে রাখবে, আমি গিয়ে নিয়ে আসব। এতে ভয়ের কিছু নেই সেটা তো মান?
বললাম, আর তার বদলে তুমি কী করবে?
কালো-মাস্টার বললে, মুখটা অমন ব্যাজার করে কথা কইছ কেন? তার বদলে ওকে বারোটা কার্ড পাইয়ে দোব বলেছি, ওর বন্ধুদের নিয়ে এসে আমাদের থিয়েটার দেখে যাবে। কথা তো এই। তোমাকে কোনো বিপদে ফেলব না, প্রাণ থাকতে কালো-মাস্টার। যাই, ছোটকা বড়কার কাছে বিদেয় নিয়ে পা বাড়াই।
বলে চলে গেল তো কালো-মাস্টার কিন্তু আমার যে কত কথাই মনে হতে লাগল! প্রথম থেকেই কালো-মাস্টারকে বিশে বলে চালানোটা ঠিক হল কিনা ভেবেই পেলাম না। বিশে জানতে পারলে কী বলবে?
দূর থেকে শুনতে পেলাম পুলের ওপর দিয়ে মালগাড়ি যাচ্ছে টং লিং টং লিং টং লিং–। আওয়াজটা ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগল আর আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়লাম টের পেলাম না।
১০.
মা নিমকিকে নিয়ে আমাদের নাটক দেখতে আসবেন। বাবাও নাকি আসবেন, বড়ো পিসিমা গিয়ে কী সব বুঝিয়ে এসেছেন, তাই নাকি বাবা আমার নাটক করা দেখতে আসবেন। এখন দাড়ি-গোঁফের কথা উঠলেই তো আমি গেছি। পরদিন আমার ভাবনার কথা শুনে কালো-মাস্টার দাড়ি-গোঁফের বাক্সটা লুকিয়ে এনে ছোটকার কাছে জমা করে দিল। বলল, সাবধানে রাখবেন স্যার, এর ওপর মেলা লোকের নজর।
ছোটকা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, সে কী বিশু, এসব কী তবে চাঁদের আনা নয়?
কালো-মাস্টার হেসে বললে, জিনিস চেনেন না তাই ওকথা বলছেন। এসব জিনিস আজকাল হয়ই না, তা ও পাবে কোত্থেকে? না স্যার, এসব আমারই জিনিস। কতকাল ধরে যে এদের তেল মাখিয়ে, আঁচড়ে, কুঁকড়ে, হাত বুলিয়ে, আঠা জুড়ে, ঘুচে কুঁড়ে এইরকম চেহারা বানিয়েছি সে আর কী বলব। এগুলোকে আর এখন নকল চুলদাড়ি বলা চলে না, এগুলোকে মানুষের চুলদাড়ি বলা চলে– একদিক দিয়ে আমারই চুল-দাড়ি-গোঁফ বলতে পারেন। এদের একটা চুল ছিড়লে আমার গায়ে লাগে। আর, হ্যাঁ স্যার, আমার কিন্তু একটা আবেদন ছিল।
ছোটকা বললেন, তা বলেই ফেলোনা, থামলে কেন? কিছু পয়সাকড়ির দরকার বুঝি? শোন চাঁদ, আমার দেরাজের টানাতে
কালো-মাস্টার জিভ কেটে হাতজোড় করে বলল, না, না, ও কী কথা স্যার! আপনার কাছ থেকে আর পহা নিলে আমার যে পাপ হবে। বলছিলাম কী, আমার জীবনে অনেকরকম ঝামেলা আছে কিনা, তা আমার শিশুপাল সাজার কথাটা একটু গোপন রাখবেন স্যার, নইলে শেষটা টানাটানি পড়ে যাবে, হয়তো শেষপর্যন্ত দেখবেন নাটকের দিনেই আমি ফেরারি।
ছোটকার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তাই কখনো হয়? তাহলে যে আমাদের সব্বনাশ হয়ে যাবে! আমি ভোঁদাদের কর্ণার্জুন রিহার্সাল দেখে এসেছি, বুঝলে, পাশের বাড়ির ঘুলঘুলি দিয়ে। একেবারে রাবিশ! সাজপোশাকের ওপর দিয়ে মেরে দেবে ভেবেছে, কেউ একবর্ণ নাটক কত্তে পারে না, ওই সিনেমা আক্টরটা তো স্রেফ একটি মাকাল ফল! ওদের নাকের ডগা দিয়ে কাপ নিয়ে বেরিয়ে যাব। যারা যারা প্রতিযোগিতায় নামছে সবাইকে কার্ড পাঠাচ্ছি, বিশু, ভোঁদারা এসে দেখে যাক নাটক কাকে বলে! ওদেরও নাকি দাড়ি-গোঁফের কষ্ট।
কালো-মাস্টার বললে, তা আর হবে না? কার সঙ্গে লাগতে এসেছে ভুললে চলবে কেন? আমাকেও বারোটা কার্ড দেবেন স্যার। আর ইয়ে, স্যার, ওরা রিহার্সালে এলে কিন্তু আমি নাটক কত্তে পারব না। প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, চারদিকে শত্রুর গিজগিজ করছে, এখানে আসা যাওয়াই একটা ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে
ছোটকা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে শুনলেন, তারপর বলে উঠলেন, ওঃ! এতক্ষণে বুঝেছি, বিশু। তুমি নিশ্চয় কোনো নামকরা কেউ, নাম ভঁড়িয়ে নাটক করছ। পাছে কেউ চিনে ফেলে তাই এত ভাবনা। এবারে বুঝেছি।
কালো-মাস্টার বললে, শুধু চিনে ফেলবে না, স্যার, দড়ি দিয়ে বেঁধে ধরে নিয়ে যাবে, এই আমি বলে রাখলাম।
ছোটকা ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, বিশু, তোমার কোনো ভাবনা নেই। আমি তোমাকে এমনি লুকিয়ে রাখব যে চাঁদ ছাড়া এ বাড়ির কেউ অবধি জানতে পারবে না। দেখো, চাতালের পাশের ঘরটা আমাদের লাইব্রেরি, ওর দরজাও ভোলা হয় না, এমনি সব পড়ুয়া এ-বাড়ির লোকরা। ওর চাবি আমার কাছে থাকে। ওর পাশেই আমার চানের ঘর, মাঝখানে দরজা আছে। তুমি ওই লাইব্রেরি ঘরে থাকবে, আমার চানের ঘরে চানটান করবে, কাকপক্ষী টের পাবে না। রিহার্সালেও কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এবার নিশ্চিন্দি তো?
কালো-মাস্টার বললে, আর আমার খাবার?
ছোটকা বললেন, বাঃ, সে আবার একটা কথা হল নাকি! আমার খাবার আমার ঘরে দিয়ে যেতে বলব, কান্তা কেবিন থেকে চপকাটলেট আনব, দু-জনে ভাগ করে খাব।