চাতালে ছোটকা, বিভুদা, ব্রজেনবাবু সবাই ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করছেন আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। আমাদের দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তারপর কালো-মাস্টার আলোর নীচে এসে। দাঁড়াতেই মুখে কারো কথা সরে না। ছোটকা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ইয়ে, এই নাকি সেই অসাধারণ বিশে? আশ্চর্য তো। ইয়ে, কী বলে, ও পারবে তো পাট করতে, চাঁদ? নাকি এখনও বল, সব বন্ধ করে দিই।
চেয়ে দেখি কালো-মাস্টারকে ঠিক একটা চোরের মতো দেখাচ্ছে। আমার একটা হাতকাটা খাকি শার্ট আর নীল হাফপ্যান্টের তলা থেকে রোগা-রোগা কালো ঠ্যাং বেরিয়ে রয়েছে, সোজা তাকাচ্ছে না কারো দিকে, সারা গায়ে যেন একটা কেমন ভয় ভয় ভাব, দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। মুখ দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। যেন চোরের হদ্দ।
এগিয়ে এসে বললাম, আচ্ছা ছোটকা, রিহার্সালের পর পোলাও-মাংস খাওয়া তো? বিশে, পার্ট বল।
আর বলতে হল না, কালো-মাস্টার চোখের সামনে বদলে গেল। আলোর নীচে এসে আগাগোড়া শিশুপালের পার্ট বলে যেতে লাগল, আর শুধু শিশুপাল কেন, শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির গলা বদলে বদলে সবার পার্ট করে যেতে লাগল্প। শুনে সকলে হাঁ, মুখে কারো কথা সরে না। প্রত্যেকটা পার্ট এত অসম্ভব ভালো করে বলে গেল যে আমি সুষ্ঠু অবাক। বলে তো ছবি আঁকে, অথচ এত ভালো থিয়েটার করে! আশ্চর্য বটে।
কুড়ি মিনিট ধরে ও একাই বলে গেল, তারপর সে অঙ্কটাকে শেষ করে তবে থামল। ছোটকা অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ছি ছি, তোমাদের লজ্জাও করে না।
আর-একটু হলেই হয়েছিল আর কী, বিভুদার দল উঠে দাঁড়িয়েছিল পর্যন্ত, এমন সময় কালো মাস্টার হাতজোড় করে বললে, আপনাদের সকলের সঙ্গে নাটক কত্তে পারাটাকেই আমি সৌভাগ্য বলে মনে করি, নইলে আমার এত কাজের মধ্যে আবার নাটক করার সময় কোথায়? তাহলে গোড়া থেকে আবার শুরু হোক, কেমন?
আর কথাটি নেই, অমনি যে-যার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল, যাদের পার্ট শেখা হয়নি তারাও দেখি হাতে একটু সময় পেলেই মুখস্থ করতে লেগে গেছে। অন্যদিন সব পালাই পালাই করে, আজ রাত এগারোটা বেজে গেল সেদিকে কারো খেয়ালই নেই। তারপর সে কী খাওয়া, অনেকদিন বাদে প্রাণ ভরে কালো-মাস্টার খেয়ে নিল। শেষে আসর ভেঙে গেল, যে-যার বাড়ি গেল, কালো-মাস্টারও মুখে দুটো পান পুরে পথ ধরল।
ছোটকা বার বার বলতে লাগলেন, কাল যেন ছটার মধ্যে আসে– সবাইকে তৈরি করে নিতে হবে তো!
উঃফ! এতক্ষণে আমার বুকের ঢিপঢিপুনি থামল। সে মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেলে বড়োকাকা বললেন, আশ্চর্য! এ-রকম তো আমি ভাবতেও পারিনি! ওকে কোথায় পেলি রে চাঁদ?
আমি তো পালাবার পথ পাই নে। বিভুদা এসে বললে, এসব থিয়েটারি লোকদের সঙ্গে মিশিস কেন রে হতভাগা?
আমি তো অবাক, এ আবার কেমন। কথা! বিপদের সময় উদ্ধার করে দিচ্ছে বলে কোথায় খুশি হবে, না উলটে ধমকানো হচ্ছে! বললাম, হিংসে হচ্ছে। বুঝি? তা ওকে ভালো না লাগে তো চলে যেতে বললেই পার। আমিই তো বলে-কয়ে এনেছি। ও কি সহজে রাজি হয়!
ছোটকা বললেন, তুমি থামো তো বিভু, নিজে মরা সৈনিকের পার্ট করতে পর্যন্ত ভুল কর, তোমার মুখে ওসব কথা শোভা পায় না। বাবা! ভাগ্যিস বিশেকে পাওয়া গেল, তাই ভোঁদার। দলের নাকের তলা থেকে কেমন কাপ ছিনিয়ে আনি দেখো। আর রাত নয়, যা চাঁদ, শুয়ে পড়, কাল আবার আর-একটা দিন আছে তো।
শুলাম বটে, ঘুম আসে না কিছুতেই। কতরকম যে ভাবনা– কালো-মাস্টার ঠিকমতো পৌঁছেছে তো, বিশে বলে ওকে চালাচ্ছি, শেষটা সব ফেঁসে না যায়। যাগে, আর ভেবে কী হবে আর তো কটা দিন। ছোটকা ওকে রোজ রাত্রে খেয়ে যেতে বলেছে, ওর উৎসাহ দেখে কে! আর আশ্চর্য যে অন্য যারা এতদিন ঝিমিয়ে পড়ছিল, তারাও সবাই তড়বড়িয়ে জেগে উঠেছে। আমার তো নিজের পার্ট আগেই মুখস্থ হয়ে গেছিল, এখন অন্য অন্য ছোটো পার্টগুলো সব মুখস্থ করে নিলাম। বলা তো যায় না, লোকের কেমন হঠাৎ হঠাৎ অসুখ করে, মরেও যায় কত লোকে। তখন তো আর ওসব সামান্য কারণে নাটক বন্ধ করে দেওয়া যাবে না!
হঠাৎ মনে হল শিশুপালই যে শুধু পাওয়া গেছে তা তো নয়, দাড়ি-গোঁফেরও একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কী যে আরাম লাগল সে আর কী বলব! আবার সঙ্গেসঙ্গে ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে গেল। এই কিছুক্ষণ আগেই নাটক ভেস্তে যাচ্ছিল আর এরই মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল, মায় কালো-মাস্টারের খাওয়ার কথাটা পর্যন্ত। যাবার আগে ছোটকা বড়কার কাছ থেকে পাঁচ টাকা চেয়ে ওর হাতে গুঁজে দিলেন। কালো-মাস্টার একেবারে গলে জল। পরে একলা পেয়ে আমি ওর কানে কানে ব্যস্ত হয়ে বললাম, ও দিয়ে কী হবে কালো-মাস্টার? আবার যেন দোকানে টোকানে যেয়ো না।
সে একগাল হেসে বললে, অত ভয় করলে কি আমাদের চলে কত্তা? তোমার কোনো ভয় নেই, স্যান্ডো আমার জন্য খাবার কিনে এনে দেবে।
–স্যান্ডো! সে আবার কে?
–ওমা, স্যান্ডোকে চেন না? ওই যে গো রেলে কাজ করে, ঝুলো গোঁফ, খুপরিঘরে নিশেন নাড়ে।
–তুমি ওকে চেন নাকি?
–বাঃ, ওকে চিনব না! তুমি তো সারাদিন আমাকে একা ফেলে নিজে মজা মার, আমি সে-সময়টা কী করে কাটাই ভেবেছ কখনো? কথা না বলে কেউ থাকতে পারে? তাই ওর সঙ্গে ভাব করেছি, তাতে অন্যায়টা কী হল শুনি?