আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ডিমের বড়া গলা দিয়ে নামতে চায় না। ছোটকা বললেন, ও কী, চুপ করে রইলি যে? বিশে কখন আসবে?
–বিশে সকলের সঙ্গে এখন রিহার্সাল করতে চাইছে না। আজ অন্যরা চলে গেলে পরে তোমার আর বিভুদার কাছে পার্ট অভ্যাস করে যাবে বলেছে। পরশু একেবারে সবার সঙ্গে রিহার্সাল করবে।
ছোটকা একগাল হেসে বললেন, আঃ, বাঁচালি চাঁদ! মাথা থেকে একটা এক-শো মন বোঝা নামল। হারে, সে ভালো করবে তো?
–ভালো করবে তো মানে? সে ব্ৰজেনদাকেও শেখাতে পারে। জানো, একবার
বিভুদা হাঁড়িমুখ করে বলল, থাক, এখন আর তার গুণের ব্যাখ্যান কত্তে হবে না। পার্ট দিচ্ছি। ওই তার পক্ষে যথেষ্ট। আর দাড়ি-গোঁফ কখন পাচ্ছি? যদি এর মধ্যে কোনো চালাকি থাকে
ছোটকা এক ধমক দিলেন, ঢের হয়েছে বিভু, নিজের এদিকে দুটো কথা বলতে গেলেই জিভ বেরিয়ে যায় আবার তেড়িবেড়ি!
বিভুদাও বললে, তুমিও থামো দিকিনি! নিজে তো লেখা কাগজ সামনে ধরেও যা খেল। দেখাও—
ছোটকা বললেন, আহা, সে আমার কিছু মনে থাকে না বলে। তা ছাড়া প্রযোজক কবে আবার অভিনয় করে?
বড়োকাকা বললেন, এখন যে-যার জায়গায় বসে খেয়ে নাও দিকিনি। হারে চাঁদ, দাড়ি গোঁফগুলো পাওয়া যাবে কখন? আমাকে আবার সাজ গোছাবার ভার দিয়েছে কিনা!
আমি বললাম, আজ সবাই চলে গেলে বিশে যখন আসবে, ওকে বলে দেব কাল পরশু একদিন সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। ওকে কিন্তু রাত্রে এখানে খেয়ে যেতে বলেছি বড়োকাকা।
ছোটকা বললেন, হ্যাঁ, হা, অবিশ্যি খাবে। আজ আমাদের বড়ো ভালো দিন– পোলাও মাংসের ব্যবস্থা কচ্ছি, দেখ-না।
০৯.
রাতের পোলাও-মাংসের কথা শুনে কালো-মাস্টার সেদিন দুপুরে পাঁউরুটি খেতে আপত্তি করল না। শুধু বললে, হা কত্তা, কাপড়চোপড় নেই, তা মওড়াতে পরব কী?
বললাম, সে একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। আমার পাঞ্জাবি পাজামা তোমার হবে না?
সত্যি কথা বলতে কী কালো-মাস্টার মাথায় আমার চেয়ে খুব বেশি লম্বা নয়; রোগা লিকলিকে– ওকে বিশে বলে কী করে যে চালাব তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভাগ্যিস বিশেকে কেউ চোখে দেখেনি! এই ছ-ফুট উঁচু ষণ্ডা জোয়ান, হাঁক দিলে গঙ্গার ওপার থেকে শোনা যায়। ওদের দেশে ছোটো ছোটো নানা রকমের আগ্নেয়গিরি আছে, তার এক-একটার চুড়োয় চড়ে ডেকে ডেকে অন্য চুডোর লোকদের সঙ্গে ওরা কথা কয়। দূর থেকে জাহাজ আসছে দেখতে পেলে অমনি জানান দেয়। সেইরকম গলাও বিশের।
টং লিং টং লিং টং লিং করে লম্বা একটা মালগাড়ি পুলের ওপর চড়ল আর সেই গুঁফো লোকটা অমনি সবুজ নিশান হাতে করে এগিয়ে দাঁড়াল। আমিও বাড়ির ছায়াতে আর একটু সেঁদিয়ে গিয়ে অবাক হয়ে বললাম, ও কী কালো-মাস্টার, সবুজ কালি, তুলি-কলম দিয়ে কী করবে? ছবি আঁকবে নাকি?
এই বলে ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম।
ও খুশি হয়ে বলল, ছবিই বটে। জানো কত্তা, সারাজীবন কত যে ছবি এঁকেছি তার ঠিকানা নেই; কত কদাকারকে সুন্দর করেছি, সুন্দরকে করেছি কদাকার! কত বুড়োকে হোকরা বানিয়েছি, ছোকরাকে বুড়ো! কত পালোয়ানকে রোগা বানিয়েছি, রোগাকে পালোয়ান! বিশে হওয়া আমার পক্ষে কী আর অমন শক্ত কথা! এই দেখো, বিশে হওয়ার আমার আর কতটুকু বাকি আছে।
এই বলে আধময়লা গেঞ্জিটাকে খুলে ফেলল। চেয়ে দেখি ওর হাড় জিরজিরে বুকের ওপর সবুজ কালি দিয়ে মড়ার মাথা আঁকা, তার নীচে দুটো হাড় ক্রশ করে বসানো, সে যে মানুষের হাড় সে আর কাউকে বলে দিতে হবে না!
এত ভালো ছবি আঁকে কালো-মাস্টার এ আমি ভাবতেও পারিনি। বললাম, আমার বুকেও ওইরকম এঁকে দাও-না, কালো-মাস্টার!
বলে জামাটা খুলে বসলাম।
কালো-মাস্টার জিভ কেটে বললে, ছি, কী যে বল কত্তা! বিশের বুকে যে উল্কি আঁকা সে কি যার-তার বুকে শোভা পায়? এসো, বরং জোড়া হাঁসের নীচে পদ্মফুল করে দিই।
তাই দিল কালো-মাস্টার। ঠান্ডা ঠান্ডা তুলিকালির টানে কী যে আরাম লাগল! হয়ে গেলে কালো-মাস্টার বললে, দেখো, স্নানের সময় যেন জল না লাগে।
কালো-মাস্টারের যেমন কথা। দু-তিন দিন স্নানই করব না ঠিক করেছি। জামা গায়ে দিয়ে ওপরে যাবার সময়ে ওকে আর এক বার সাবধান করে দিলাম, খুব সাবধান, কালো-মাস্টার, তুমি যে এখানে আছ কেউ যেন টের না পায়। বিশেষ করে খুপরিঘরের ওই লোকটা। জলের ধারে পা ঝুলিয়ে ও-রকম করে বসে থাক কেন? ও তোমাকে একবার দেখতে পেলেই হয়ে গেল। তোমার শিশুপাল সাজা এ আমি বলে দিলাম।
তাই শুনে কালো-মাস্টার একেবারে চোরাকুঠরির ভিতরে গিয়ে বেদিটার উপরে টান হয়ে শুয়ে পড়ল। আমিও আস্তে আস্তে উপরে এসে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লাম। একটু ভাবনাও হচ্ছিল, কী জানি ওই লোকটাকে বিশে বলে চালাতে গিয়ে শেষটা না কোনো ফ্যাসাদে পড়ি। বাবা যদি কোনোরকমে টের পান তাহলেই তো গেছি!
বিকেলে কালো-মাস্টারকে আনাই দেখি এক ব্যাপার! সে কিছুতেই পাঁচিলে চড়ে নালার ওপর দিয়ে যেতে পারল না। খালি নীচের দিকে তাকায় আর ওর মাথা ঘোরে। শেষটা ও-পথ ছেড়ে দিলাম। তা ছাড়া সরু জায়গাটাতে হয়তো ওর পেটটা গলতই না। কারণ এদিকে রোগা হলে কী হবে, ওদিকে এই ক-দিনে দিব্যি এক নাহাপাতিয়া বাগিয়েছে।
অগত্যা সন্ধ্যে লাগলে পর নৌকো বের করে কান্তা কেবিনের একটু আগে গাছগাছড়ায় আড়াল-করা একটা আঘাটায় নামলাম দুজনে। কালো-মাস্টার জলকে বিশ্বাস করে না, নৌকো টেনে ডাঙায় তুলে কারখানার উঁচু পাঁচিলের গা ঘেঁষে ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে রাখল। সেখান থেকে অন্ধকার গলি দিয়ে হেঁটে গেলে আমাদের বাড়িটা বেশি দূরে নয়। গুফো লোকটা রুটি সেঁকছিল, কিছুই লক্ষ করল না।