অবাক হয়ে চেয়ে দেখি এই একটু আগে মুড়ির সঙ্গে তেলেভাজা খেয়ে যার মুখ হাসিতে ভরে ছিল এখন তার অন্য রূপ। পিঠ-বাঁকানো বনবেড়ালের সঙ্গে আর তার কোনো তফাত নেই। চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, খবরদার, ওতে হাত দিস নে বলছি। অধম্মের কাজ করে, প্রাণ হাতে করে ওর জন্য আমি বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে আছি। ছুঁয়ো না বলছি। আগে বলো আমি যা বলব তাই হবে!
ছুটে পালাতে যাচ্ছি, খপ করে আমার হাতের কবজি ধরে ফেলে কালো-মাস্টার বললে, ওঃ! বিশেষ বন্ধু বুঝি বিপদের সময় পালিয়ে যায়! আমি কোথাকার একটা কালো-মাস্টার আমি প্রাণ তুচ্ছ করে দাড়ি-গোঁফ আগলে আছি, খেতে পাই নে, ভালো একটা বিছানা পাই নে, এই আমি যার চারটে বালিশ আর দুটো বড়ো পাশবালিশ না হলে ঘুম হত না–আর দরকারের সময় তুমি দিব্যি চম্পট দিচ্ছ! বিশে শুনলে কী বলবে শুনি?
ব্যস্ত হয়ে বললাম, ইয়ে– না– চলে তো যাচ্ছিলাম না।
সে বললে, তাও ভালো। তবে শোনো, এই দাড়ি-গোঁফ সব তোমাকে দেব, কিন্তু তার বদলে বিশে সাজবে শিশুপাল।
আমার মুখে কথাটি নেই। কালো-মাস্টার আমার দিকে চেয়ে বললে, কী বলতে চাইছিলে বলেই ফেলল। বিশে থিয়েটার করবে না, এই তো? আহা, তুমিও যেমন! আরে আমিই বিশে হয়ে শিশুপাল সাজব, তাও বুঝলে না?
উঃ, বাঁচা গেল! মনটা হালকা হয়ে গেল।
–কিন্তু
কালো-মাস্টার বললে, এর মধ্যে আবার কিন্তু কী? এতে কার কী অসুবিধেটা হচ্ছে শুনি? আমি এখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত বিশে আসছে না এটা তো ঠিক? কাজেই সে কোন গোলমাল করতে পারবে না। তোমার ছোটকারা তো যেমন করে তোক একটা শিশুপাল পেলেই খুশি! তাহলে আর আপত্তিটা কোথায়? আমার জীবনের আশা শিশুপাল সাজব।
বললাম, কিন্তু তোমার শত্রুরা যদি তোমাকে ধরে ফেলে?
কালো-মাস্টার এত জোরে হো-হো করে হেসে উঠল যে আমার ভয় হতে লাগল ওপর থেকে যদি ওরা শুনে ফেলে! কালো-মাস্টার বললে, কিছু মনে কোরো না, আমি যাকে শিশুপাল সাজাব অন্য লোকে তাকে চিনে ফেলবে এ কথা শুনলেও হাসি পায়। কেউ চিনবে না, বুঝলে। আমি শিশুপাল সাজলে আমি আর আমি থাকবনা, সত্যি করে শিশুপাল হয়ে যাব, এও কি বলে দিতে হবে? জানো মণি পালকে এমন জটায়ু সাজিয়েছিলাম যে অনেকদিন পর্যন্ত তার মুখ থেকে কিচিরমিচির ছাড়া কোনো শব্দ বেরুত না।
বললাম, পারবে তো কালো-মাস্টার? পার্ট দেখলে না, রিহার্সাল করলে না, শেষটা সব ডোবাবে না তো?
তাই শুনে সে হাত-পা ছুঁড়ে তখুনি শিশুপালের পার্ট আগাগোড়া এমন চমৎকার বলে যেতে লাগল যে আর আমার কোনো আপত্তিই থাকল না। শুধু ওকে ওই বিশে বলে চালানোতেই যা মুশকিল। সে বুঝিয়ে বললে, বুঝলে, আগে আমি বিশে সাজব। তারপর ওই বিশে শিশুপাল সাজবে। এতে অসুবিধেটা কোথায় বুঝলাম না।
বললাম, বিশের বুকে মড়া মানুষের খুলির নীচে ক্রশ করা হাড় উল্কি করা আছে।
–তা আছে তো তাতে হয়েছে কী? আমিও সবুজ কালি দিয়ে চমৎকার মড়া মানুষের খুলির নীচে ক্রশ করা হাড় আমার বুকে এঁকে নেব। ওসব বাজে কথা রাখো। এখন বলো বিশে আমার চেয়ে কোন দিক দিয়ে ভালো।
বললাম, ইয়ে, বিশের মুখটা
-কী মুখটা? আমি দাড়ি কামিয়ে পাউডার মেখে নিলেও বিশের মুখটা ভালো? বাজে কথা বোলো না, বলো আর কীসে ভালো।
বললাম, কী লম্বা-চওড়া বিশে, হাতের পায়ের গুল কী শক্ত! সঙ্গে সিংহ থাকে।
কালো-মাস্টার তো অবাক।
–সিংহ থাকে! এই সেদিন-না বললে কুকুর থাকে?
-আহা, ওই একই, কুকুরের নামই সিংহ।
–কুকুরের নাম সিংহ হবে কেন?
–আহা চট কেন, রিহার্সালের সময় সিংহকে বাড়িতে রেখে আসব। আর হাতের পায়ের গুল যে বলছ, কী এমন মন্দ আমার হাতের পায়ের গুল?
এই বলে হাত-পা বেঁকিয়ে মাস্ল ফুলিয়ে আমাকে আবার দেখাতে লাগল। দেখে হাসি পেল, কীসে আর কীসে! বললাম, দেখো, তুমি যাই বলনা কেন–
সে আর অপেক্ষা না করে দাড়ি-গোঁফগুলোকে জড়ো করতে লাগল। দ্বিতীয় সৈনিকের গোঁফে যেই হাত দিয়েছে আমি বললাম, কথায় কথায় রাগ কর কেন? দেখি একবার ছোটকার সঙ্গে কথা বলে।
কালো-মাস্টার ছুটে এসে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরল। বলল, দাও বাপ, চাট্টি পায়ের ধুলো দিয়ে কেতাত্থ করে দাও।
ঘরে ফিরে এসে ভেবে দেখলাম এতে খুব সুবিধেই হয়ে যায়। শুধু মিথ্যে করে বিশের নামে কালো-মাস্টারকে চালাতে খারাপ লাগছিল। তবে বিশে যে এতে কিছু মনে করবে না এ আমার খুব জানা ছিল। কারণ যদিও বিশে লোকের সামনে বেরোয় না আর আমাদের বাড়ির লোকদের ভারি ঘেন্না করে, তবু সে কথা তো আর এরা কেউ জানে না। ওরা ভাবে বিশে বুঝি এ-পাড়ার কাছাকাছি কোথাকার একটা বখা ছেলে। তবে আর কালো-মাস্টারকে বিশে বলতে ক্ষতি কী? আমি অবিশ্যি ওকে কালো-মাস্টারই বলব, বিশে বলে ডাকতে পারব না কক্ষনো।
দুপুরে খিচুড়ির সঙ্গে সাত-রকমের ভাজা হয়েছিল। খেতে খেতে সবার সামনেই বললাম, দাড়ি-গোঁফের একটা ব্যবস্থা করেছি ছোটকা, আর বিশে শিশুপালের পার্ট করতে রাজি হয়েছে।
তাই-না শুনে যে যার পিঁড়ি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বড়োকাকিমার হাতা থেকে আমার পাতে দুটো বড়ো বড়ো মাছের ডিমের বড়া পড়ে গেল। একা বড়োকাকা আর আমি বসে থাকলাম।
বড়োকাকা খিচুড়ির সঙ্গে কাঁচালঙ্কার কুচিভাজা মাখতে মাখতে বললেন, দাদাকে শেষ পর্যন্ত মত করালি বুঝি? বাবা, আমি বলতে গেলে সে কী রাগ, পারলে থিয়েটার বন্ধ করে দেয়!