ছোটকা বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা, তোকে একটা ভালো পেনসিলকাটা দেব। এবার হল তো?
আমি বললাম, কোন পেনসিলকাটাটা? ওই যেটা বিভুদা নেয়নি, সেটাতে তো শিষ ভেঙে যায়।
ছোটকা বললেন, কী মুশকিল! আচ্ছা, তোকে একজোড়া সাদা খরগোশ এনে দোব, আমার বন্ধু জীবনের বাড়ি থেকে। তা হলে হবে তো?
বললাম, ইস্ সত্যি দেবে তো?
–আরে হা! হা! আমার কাজটা করে দে তো আগে।
–বলো, কী কাজ?
–তোর ওই বিশেটিকে রাজি করিয়ে শিশুপালের পাট করাতে হবে। তোর কথায় তো মনে হয় ও সব পারে।
শুনে কাঠ হয়ে গেলাম।
–বিশে তো করবে না ছোটকা।
–আহা, তাকে রাজি করাতে হবে। নইলে কী বলছি? তাকে একবারটি আমার কাছে এনে দিতে পারবি তো? নাকি তাও না?
আমি চুপ করে থাকলাম। ছোটকা উঠে পড়ে বললেন, তবে থাকগে। কাল সবাইকে বলে দিই যে নাটক হবে না।
–ও মা! নাটক না হলে আমি দ্বিতীয় সৈনিক হব কী করে? ব্যস্ত হয়ে বললাম, না, না, ছোটকা, দেখি একবার চেষ্টা করে।
০৮.
সকালে মার কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়ে কী যে ভালো লাগল। মা লিখেছেন পুজোর ক-দিন নিমকিকে নিয়ে এখানে কাটিয়ে যাবেন, বিভুদাদের নাটক দেখবেন। নিমকিও চিঠির কোনা দিয়ে এত বড়ো কাগ এঁকে দিয়েছে। কতদিন নিমকিকে দেখিনি। বিশেকে নিমকির কথা বলেছি; রাত্রে একা উঠতে ভয় পায়, আমাকে সঙ্গে যেতে হয় এসব কথা বলেছি। বিশে বলেছে ওকে সাহসী করতে হবে। নিমকি এখানে এলে বেশ হবে, সাহসী করবার জন্য ওকে পেরিস্তানে নিয়ে যাব। ওই সরু জায়গাটা একবার পার হতে পারলেই ও সাহসী হয়ে যাবে।
কিন্তু মাকে কিছু বলা যাবে না, বড়োরা বড্ড কথা জিজ্ঞেস করে। তা ছাড়া বিশের কথা শুনলে কী বলবেন কে জানে! হয়তো বলবেন, ওকে ওপরে নিয়ে আয়, আমাদের সঙ্গে চা-জলখাবার খাবে।
বিশে চা খায় না। সিংহকে দিলে হয়তো খেত, কিন্তু বিশে দেয় না। মা তো সিংহকে দেখলে ভয় পাবেন। মা কুকুর ভালোবাসেন না, বলেন ওরা নাকি ভারি নোংরা। একবার বাবা একটা কুকুরবাচ্চা এনেছিলেন; আপিসের সায়েব দিয়েছিল ছোট্ট, হলদে রঙের, ঝাঁকড়া চুল, কুতকুতে চোখ, বাবার কোলে চড়ে এসেছিল। মা দেখেই প্রায় মুচ্ছো যাবার জোগাড়! বললেন, এক্ষুনি ফিরিয়ে দিয়ে এসে ওটাকে। কে ওকে খাওয়াবে, চান করাবে, ময়লা পরিষ্কার করবে শুনি? জগুর যা ঘঁচিবাই, আর আমি তো ছোঁবও না– ও কী করছ, কাছে এনো না বলছি– উঃ!
বলে মা হাত-পা এলিয়ে সোফার ওপর পড়েই গেলেন।
কত করে বললাম নিমকি আর বাবা আর আমি ওর দেখাশুনো করব, সে কিছুতেই কিছু হল। শেষটা বাবা সত্যি সত্যি হরেনকাকাদের বাড়িতে কুকুরটাকে দিয়ে এলেন। ইস, ওদের বাড়ি গিয়ে দেখেছি কুকুরটা ওদের হাত-পা চাটে! সিংহ রোজ আমার নাকমুখ চেটে দেয়, আমি একটুও ভয় পাই না।
সকালের জলখাবার খেয়ে যে-যার কাজে গেলে দেখি একটা তেলেভাজাওয়ালা ঝাঁকা নামিয়ে খিড়কি দোরের ধারে বসেছে। পাঁচিলের ওপর দিয়ে এক ঠোঙা কিনলাম, কিছু মুড়ি কিনলাম ওর কাছেই ছিল। লোকটা খুব খুশি, মাথায় আঁকা তুলতে তুলতে বলতে লাগল, খেয়ে দেখো খোকাবাবু, সারাজীবন জিভ চুলকুবে।
খুব ইচ্ছে করছিল তবু একটাও খাইনি, মা বারণ করেন।
পেরিস্তানে গিয়ে দেখি চোরাঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেক ধাক্কাধাক্কি করবার পর কালো-মাস্টার বেরিয়ে এসে বলল, কী, লাগিয়েছ কী বলো তো? পাড়া ডেকে এখানে এনে জড়ো করবে নাকি?
তারপর আমার হাতে ঠোঙা দেখে খুশি হয়ে বলল, ও কী, এনেছ কী? আহা, বেঁচে থাকো বাপ, এক-শো বছর পরমাই হোক।
এই বলে পেঁয়াজি, বেগুনি, ফুলুরি একটা করে মুখে পোরে আর একমুঠো মুড়ি খায়। আমার তাই দেখে দেখে জিভের জলে পেট ঢাক!
খেয়েদেয়ে কালো-মাস্টার নালার জলে হাত ধুয়ে আমাকে বললে, দেখবে এসো, কী ব্যবস্থা করেছি।
বলে আমাকে চোরাঘরে নিয়ে গেল।
দেখে আমার মাথাটাথা ঘুরে একাকার। দেখলাম ঘরের মাঝখানকার বেদিটার ওপরে সারি সারি দাড়ি-গোঁফ সাজানো। লম্বা দাড়ি, বেঁটে দাড়ি, খোঁচা দাড়ি, ছুঁচলো দাড়ি, চারকোনা দাড়ি, সোজা দাড়ি, কোঁকড়া দাড়ি, লাল দাড়ি, কালো দাড়ি, সাদা দাড়ি, হলদে দাড়ি, ছাগল-দাড়ি, দোভাগা দাড়ি। আর সে কী গোঁফ! বুরুশ গোঁফ, পাকানো গোঁফ, ঝোলা গোঁফ, শজারু গোঁফ, বেড়াল গোঁফ, মাঝখানে চাচাছোলা দু-ধারে গোঁফ, দু-ধারে চঁচাছোলা মাঝখানে গোঁফ, প্রজাপতি গোঁফ, মশার মতো গোঁফ।
দেখে দেখে আর আমার চোখ ফেরে না! এত গোঁফ দিয়ে যে আমাদের সারাজীবন সুখে কেটে যাবে। গলা দিয়ে আমার কথা। বেরোয় না, শেষটা ভাঙা গলায়। বললাম, কোথায় পেলে কালো মাস্টার? খেতে পাও না, গোঁফ-দাড়ি কোথায় পেলে?
কালো-মাস্টার বললে, আমার। নৌকোর ভেতরটা এই দিয়ে ভরে ছিল যে। জলে ভিজে জাবড়া হয়ে এর সঙ্গে ও এঁটে ছিল, এর রং। গড়িয়ে ওর গায়ে লেগে ছিল। এতদিন ধরে রাত জেগে না ঘুমিয়ে না খেয়ে
আড়চোখে একবার আমার দিকে চেয়ে আবার বলতে লাগল, না ঘুমিয়ে, আধপেটা খেয়ে, জট ছাড়িয়ে, রং ধোলাই করে, তেল মাখিয়ে, পাতা কেটে, কোকড়া আঁচড়িয়ে, তবে সে-না ভোল ফিরিয়েছি। এখন এরকম বলা যেতে পারে এরা আমারই হাতে তৈরি। নেবে এগুলো? তাহলে কিন্তু আমার একটা কথা রাখতে হবে।
দাড়ি-গোঁফের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে দেখতে লাগলাম। আহা, ওই লালচে পাকানো গোঁফ-জোড়াটি দ্বিতীয় সৈনিকের গোঁফই বটে। হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে ছুঁতে গেলাম, ফোঁস করে উঠল কালো-মাস্টার।