–ওই তো আমার ছোটকা, উনি তো শিশুপাল করবেন না।
পারবেই না তো করবে কোত্থেকে! –আচ্ছা তুমি দাড়ি-গোঁফ দিচ্ছ তাহলে? আমি সব শুনেছি।
আমি আর কী করি, চুপ করে জলের দিকে চেয়ে থাকলাম। হাঙররা এলে ওদের গায়ের সবটা জলের নীচে থাকে, কিচ্ছু দেখা যায় না, খালি ওদের তিনকোনা পাখনাটা জলের উপর ভেসে থাকে, আর তাই দেখে মাঝিমাল্লারা সাবধান হয়ে চলাফেরা করে।
কালো-মাস্টার আমাকে একটা ঠেলা দিয়ে বললে, কই, কিছু বলছ না যে? দাড়ি-গোঁফ কোত্থেকে কিনছ?– ও কী, মুখ ঢাকছ কেন, কাঁদছ নাকি?
নাক টেনে বললাম, না, কঁদব কেন? আমি তো বিশের বন্ধু। কিন্তু ওই বিভুদা সারাক্ষণ খালি খালি বলে দাড়ি-গোঁফ এনে দে, দাড়ি-গোঁফের কী ব্যবস্থা কল্পি– আর খুব জোরে মারে। এই দেখো, হাতের গুলি টেনে নীল করে দিয়েছে।
কালো-মাস্টারের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, একটা আঙুল দিয়ে আমার ব্যথার উপর হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি হেসে বললাম, ও কিছুনা, ও সেরে যাবে। বিশেদের হাত-পা কেটে গেলে ওরা পাথর দিয়ে গাদাফুলের পাতা ঘেঁচে ব্যথার উপর লাগায়, হাড়ভাঙার ডগা বেটে মাখে, একেবারে সেরে যায়। কিন্তু দাড়ি-গোঁফ আমি কোথায় পাব? কিনতে নাকি অনেক টাকা লাগে। বাবা থিয়েটার ভালোবাসেন না। বাবা তো টাকা দেবেন না। শুনলে হয়তো আমার থিয়েটার করাই বন্ধ করে দেবেন।
কালো-মাস্টার নদীর দিকে তাকিয়ে বললে, দাড়ি-গোঁফ তা ভাড়াও পাওয়া যায়।
পাঁচ টাকায় পাওয়া যাবে? তোমাকে মাংস-ভাত খাবার বারো আনা দিলে আমার কাছে যে পাঁচ টাকা থাকবে তাই দিয়ে কি পাওয়া যাবে?
–বাঃ, পুজোবার্ষিক কিনবে না? কী সুন্দর চকচকে মলাট দেয়া থাকে! কিনবে না? না কিনলে তোমার মা কী বলবেন?
মা কাছে থাকলে তো কোনো ভাবনাই ছিল না, এক্ষুনি দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা করে দিতেন। পরীক্ষার সময় মা আমাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দেন, আর মুরগির স্টু বেঁধে খাওয়ান। ঘরে এলেই কীরকম একটা ভালো গন্ধ পাই।
কালো-মাস্টার বললে, ও কত্তা, মার কথা মনে পড়ে কষ্ট হচ্ছে বুঝি? তা মা কাছে না থাকতে পারে, কালো-মাস্টার তো আছে। পয়সাকড়ির জন্য তুমি ভেব না, আমার যা আছে তাইতেই আমার কিছুদিন হেসেখেলে চলে যাবে!
এই বলে ট্যাক থেকে একটা ছোটো কালো থলি বের করে, তার মুখ খুলে, হাতের তেলোয় এতএত পয়সাকড়ি ঢেলে দেখাল। আমি তো অবাক!
–ও কালো-মাস্টার, এত তুমি কোথায় পেলে? ওই দিয়ে তো তুমি সারাজীবন সুখে থাকতে। পার!
কালো-মাস্টার বললে, দেখো, কাল তোমার পুজোবার্ষিক কিনে ফেলল। তার একটা আমাকে পড়তে দিয়ো, কেমন? এখানে একা একা পড়ে থাকি। বাইরে এসে জলের ধারে পা ডুবিয়ে যে বসে থাকব তারও জো নেই, যদি কেউ দেখে ফেলে!– আচ্ছা রেলের ধারের ওই খুপরিঘরের . গোঁফওয়ালা লোকটাকে দেখেছ?
শুনে আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। কালো-মাস্টার বললে, উঃ, ওর দিকে তাকানো যায় না। কাজকাম নেই, সারাদিন শুধু খাই আর খাই! জান, ব্যাটা মাঝে মাঝে উঠে একটা নিশান নেড়ে দেয়, তা ছাড়া সারাক্ষণ শুধু খাবার তালেই আছে! কাটছে বাটছে রাঁধছে, তারপর খাচ্ছে, বাসন মাজছে, পান খাচ্ছে! ওইসব কত্তে কত্তে আরেক বার খাবার সময় হয়ে যাচ্ছে! কত আর সইব, একদিন তেড়েফুঁড়ে গিয়ে ওর খাবারে যদি ভাগ না বসাই–ও কী কত্তা, মুখটা এমন কচ্ছ কেন? ভয় পেলে নাকি?
ভয়? বিশের বন্ধুর আবার ভয়? বললাম, না না, ভয়, তবে অন্য লোকের খাবার কক্ষনো খেতে হয় না। বলল, তুমি ওর কাছে যাবে না?
কালো-মাস্টার বললে, না, না, কত্তা, কিচ্ছু ভেব না। আমি জানি তুমি কত কষ্ট করে আমাকে এখানে লুকিয়ে রেখেছ, আমার জন্য খাবার আনছ, আমি আছি বলে তোমার বন্ধু বিশে আসতে পাচ্ছে না। আমি নিতান্ত নেমকহারাম নই, কত্তা। আজ অনেক রাত হল গে, যাও, শুয়ে পড়ো! এই আমি কথা দিলাম, তোমার দাড়ি-গোঁফের আর শিশুপালের ব্যবস্থা আমি করে দেব। এখন অনেক রাত, তুমি শোও গে।
আঃ, শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। গুটিগুটি চলে এলাম। পাঁচিল দিয়ে খিড়কি বাগানে, খিড়কি বাগান থেকে জানালা দিয়ে আমার স্নানের ঘরে, সেখান থেকে আমার শোবার ঘরের মধ্যে।
ঘরে ঢুকে জুতোটা খুলে খাটে সবে বসেছি, এমনি সময় মনে হল কে আমার দরজা ঠেলছে! আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দাঁতে ছোরা কামড়ে ধরে, খোঁচা খোঁচা চুল লাল চোখ, একটা লোক যদি এবার এসে ঘরে ঢোকে?– বিশে হলে কী করত?
খাট থেকে নেমে, ঘরের আলো জ্বেলে, দরজার ছিটকিনি খুলে দিলাম, হুড়মুড় করে ছোটকা আমার ঘরে ঢুকলেন, কী ঘুম রে বাবা তোর! সেই কখন থেকে দরজা ঠেলছি, সাড়াশব্দ দিচ্ছিস নে! জোরে ডাকতে পারছি না, পাছে বিভুকাকড়াবিছে শুনতে পায়। শোন, নাটক করে কাপটা পেতে পারলে, এশহরে আর আমি মুখ দেখাতে পারব না। এটা তো বুঝিস? শোন, একটা কাজ করে দিস তো একটা খুব ভালো জিনিস দেব তোকে।
আমি বললাম, কী ভালো জিনিস?
ছোটকা গেলেন রেগে। চাপা গলায় বললেন, এমনি দেখে মনে হয় বুঝি গাল টিপলে দুধ বেরুবে। অথচ ভেতরে ভেতরে এত বিষয়বুদ্ধি! যা, তোকে দুটো টাকা দেব।
আমি বললাম, দু-টাকা আমি চাইও না, আর তোমার নেইও। তুমি তো বড়োকাকিমার কাছ থেকে এক টাকা চাচ্ছিলে চা খাবার সময়।