বিভুদা বললে, সে আমি পারব না। এক চড়েই যাদের জিভ বেরিয়ে যায়, তাদের পায়ে আমি ধরতে পারব না।
–তাহলে কী হবে? আমিই একবার চেষ্টা করে দেখব না কি?
বিভুদা দারুণ রেগে গেল, দেখো ছোটকা, যা ইচ্ছে তাই করে করে তোমার বড্ড বাড় বেড়ে গেছে দেখছি। আমার পার্ট যদি অন্য কাউকে দাও, তোমার নাটক কেমন করে হয় দেখব। এক্ষুনি খনা, নন্টু, বাচন, ভুবন, সব্বাইকে নিয়ে ভোঁদার দলে চলে যাবনা! কী রে, তোরা আমার সঙ্গে আছিস তো?
অমনি তারা সবাই চেঁচাতে লাগল, হা ওস্তাদ, আমরা সঙ্গে আছি, আমাদের চপ-কাটলেট খাওয়াও।
ব্ৰজেনদা এবার গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলেন, দেখো, নাটক সত্যি হবে কিনা বলল। রোজ সন্ধ্যেবেলা প্রাইভেট টুইশন বন্ধ রেখে আসব, আর ঝগড়াঝাটি ছাড়া আর কিচ্ছু হবে না যদি, তো থাক গে, আমার কাজ নেই।
ছোটকা ওঁর হাত ধরে বললেন, যাস নে ভাই, পরোটা-কাবাবগুলো না খেয়ে যাস নে।
শেষপর্যন্ত রিহার্সাল শুরু হল। ছোটকা শিশুপালের পার্ট ভুলভাল করে পড়তে লাগলেন। আমি কালো-মাস্টার যেমন শিখিয়ে দিয়েছিল তেমনি করে বলে যেতে লাগলাম। শেষের দিকে বড়োকাকা এসেছিলেন শুনে বললেন, বা! বা! তুই যদি আরও এক গজ লম্বা হতিস তো। তোকেই শিশুপাল করে দিতাম।
ছোটকা বিরক্ত হয়ে বললেন, থামো মেজদা, ঠাট্টার সময় ইয়ার্কি ভালো লাগে না।
০৭.
অনেক রাত্রে কালো-মাস্টারের খাবার নিয়ে গুটিগুটি পেরিস্তানে গেলাম। সে তো ওই খাবার দেখেই রেগে কই! বলে, খিদেয় পেট জ্বলে গেল, আর এই অর্ধেক রাত কাবার করে শুধু ক্ষীর আর পাঁউরুটি আর কলা আনলে! আমার মাংস-ভাত কই?
আমি ভেবেছিলাম দেখা হলেই বুঝি কালো-মাস্টার আমার অভিনয়ের সুখ্যাতি করবে; তা নয়, উলটে আবার রাগ দেখানো হচ্ছে! বললাম, কত কষ্ট করে আনতে হয়, তা তো জান না। ভাত পাব কোথায় শুনি? ডুলি খুলে যা পাই তাই আনি। তাই নিয়ে আবার কত কথা হয়। কত রাগারাগি! তা ছাড়া ভাতের চেয়ে আটা-ময়দা খাওয়া অনেক ভালো।
কালো-মাস্টার মুখের গ্রাস নামিয়ে রেখে বললে, কে বলেছে পাঁউরুটি আটা-ময়দার তৈরি? পষ্ট দেখতে পাচ্ছি শুধু কতকগুলো ফুটো দিয়ে তৈরি। ময়দা দিয়ে কতকগুলো ফুটো একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছে, সে কখনো খাওয়া যায়?
বলে আবার চোখের কোণ দিয়ে আমার মুখটা চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। আমি ঘাসের উপর ওর পাশে বসে বললাম, দেখো, একটা কাজ করলেই তো পার। রাত্রে এদিকে কেউ থাকে না, তুমি তোমার নৌকোটা করে আস্তে আস্তে তীরের কাছ দিয়ে দিয়ে গিয়ে কান্তা কেবিন থেকে মাংস-ভাত খাও না কেন? ওদের নিজেদের ছোটো ঘাট আছে। অনেক মাঝি ওখানে এসে, রান্নাঘরের পেছনে জলের ধারে বসে অ্যাও বড়ো বড়ো থালায় করে ভাত খেয়ে যায় দেখেছি। লাল লঙ্কা দিয়ে ভাত মেখে খায়। সামনে নৌকা বাঁধা থাকে–
কালো-মাস্টার হঠাৎ হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল, আর বোলো না, কত্তা, জিভে জল ঝরতে লেগেছে। কান্তা কেবিনটা কোথায়?
কিন্তু কান্তা কেবিনে যাবার পথে একটা বিপদ আছে। মাঝখানে পড়ে ওই রেলের লাইনের সেই লোকটার খুপরি ঘর। সে যদি একবার টের পায়! টং লিং–টং লিং টং লিং করে লম্বা একটা মালগাড়ি পুল পার হতে লাগল। দেখি লোকটা তার সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে লাল-সবুজ লণ্ঠন তুলে ধরেছে আর বার বার এদিকে তাকাচ্ছে। কিছু দেখা যায় না জানি, তবু খানিকটা সরে বসলাম।
কালো-মাস্টার বললে, বেশি পহা চাইবে না তো? আমার বড় টানাটানি যাচ্ছে এখন। অথচ দেশের বাড়িতে সোনাদানা গড়াগড়ি যায়। এই গোছ গোছ কাঁসার থালা, তার এক-একটারই ওজন হবে আড়াই সের, আর আমি কিনা একটা ছেঁড়া খবরের কাগজের টুকরোতে একটা নোংরা হাতলভাঙা পেয়ালা বসিয়ে, শুকনো পাঁউরুটি চিবুচ্ছি!
এই বলে এক টুকরো পাঁউরুটি ছিঁড়ে ক্ষীরে ডুবিয়ে জবজবে করে নিয়ে মুখে পুরল। কাল হবে একচোট ওই ক্ষীর নিয়ে। নাকি মালপো হবে বলে তুলে রাখা হয়েছে। রোজ বামুনদিদি বিভুদাকে বকাবকি করে, ও আর কদ্দিন সইবে? পাহারা-টাহারা দিয়ে একাকার করবে, তখন খাবার আনাই দায় হবে।
কালো-মাস্টারকে বললাম, পয়সা আমি কিছু তোমাকে দিতে পারি। দুটো পুজোবার্ষিক কেনবার জন্য মা আমাকে পাঁচ টাকা বারো আনা দিয়েছেন, তার খানিকটা তুমি নিতে পার।
সে তো গেল রেগে।
–ওঃ, একটা দুঃখী মানুষকে দু-বেলা দুমুঠো অখাদ্য দিতে বুঝি ভারি কষ্ট হচ্ছে? থাক তবে, আমি উপোস করেই থাকি!– আচ্ছা, ওদের ওই রান্নাঘরের পেছন দিকটা বেশ নির্জন তো? বাবুরা আশা করি সেখানে আসেটাসে না মানে আমাকে ওরা একবার ধরলে তো আর আস্ত রাখবে না!
বললাম, আরে না, না, অত ভয় কীসের? জান, আমার বন্ধু বিশেকে একবার কুমিরে ধরেছিল। তবু বিশে ভয় পায়নি, এমনি করে কুমিরের দুটি চোয়াল ধরে টেনে হাঁ-টাকে বড়ো করে দিয়ে কামড় ছাড়িয়ে চলে এসেছিল।
কালো-মাস্টার বললে, সে কী! মারল না কুমিরটাকে? আবার শেষটা কাকে ধরবে। নরমাংসের আস্বাদ পেয়েছে!
–আহা! কুমিরের কামড়ে আইডিন দিতে হবে না বুঝি? মারবার সময় কোথায়? তা ছাড়া কামড় ছাড়াবার সময় এমনি জোরে চাড় দিতে হয়েছিল যে তাইতেই কুমিরটা একেবারে মরে গেছল।
কালো-মাস্টার বললে, সাহস দাও তো একটা কথা বলি। আচ্ছা ওই আনাড়িটা কে, ওই যে ভজকট করে শিশুপাল করছিল?