–বলব আবার কী? লোকই পাওয়া যাচ্ছে না।
-কেন, তোমার ছোটকা সবাইকে শেখাচ্ছেন, উনি নিজে করেন না কেন?
–আহা, ছোটকা করবেন কী করে? ওঁর যে কিছুই মনে থাকে না, উনি পার্ট মুখস্থ করবেন কী করে? উনি তো রোজ বাজার থেকে ভুলে গিয়ে যা-তা আনেন বলে রাগারাগি হয়। কিছু মনে থাকে না বলেই তো কোনো কাজও করেন না। বড়োকাকা কারবার দেখতে বলেন, তা উনি হিসেব রাখতেও ভুলে গেছেন বলে সেখানে যান না। উনি পার্ট করবেন কী করে?
কালো-মাস্টার তখন বললে, তা হলে তোমার বন্ধু বিশেকে পার্টটা দাও না কেন!
-না না, তাই কখনো হয়?
–কেন, ও বুঝি থিয়েটার কত্তে পারে না?
ভারি বিরক্ত লাগল। এমন বোকার মতো কথা বলে লোকটা! বললাম, তা পারবে না কেন? এসব সামান্য পার্ট করা ওর পক্ষে কিছুই নয়। জানো, ওকে একবার শত্রুরা আর একটু হলেই ধরেছিল, তখন ও শত্রুদের সর্দার সেজে ওদের নাকের সামনে দিয়ে চলে এসেছিল। কেউ টেরও পায়নি! বললাম-না, ও এ বাড়ির লোকদের সঙ্গে মিশবেই না, তা নাটক করবে কী করে?
চলে এলাম আবার নিজের ঘরে। তারপর সেদিনকার রিহার্সালে সে কী ঝগড়াঝাটি! ভোঁদার দলের দু-জন লোক মজা দেখতে এসেছিল নাকি! দিয়েছে বিভুদা তাদের মেরে অপমান করে তাড়িয়ে। এসব অবশ্যি আমার চোখে দেখা নয়। রিহার্সাল শুরু হবে এমনি সময় ছোটকা হন্তদন্ত হয়ে চাতালে এসে বললেন, কই, নগা আর ভোলা আসেনি এখনও?
ব্যস, কারও মুখে আর কথাটি নেই। ছোটকা ব্যস্ত হয়ে ইদিক-উদিক ঘোরাফেরা করতে করতে বলতে লাগলেন, কী মুশকিল! ওরা দুজনেই শিশুপালের পার্ট করেছে, তাই এত খোশামুদি করে কান্তা কেবিনে চা-চপ খাইয়ে রাজি করিয়ে এলাম; ব্যস্, এখন কারো পাত্তা নেই! তুই এক বার নগাদের বাড়িতে যা দিকিনি বিভু, ওর পার্ট একেবারে মুখস্থ হয়ে আছে–যা তো চট করে।
বিভুদা বললে, যা তো আবার কী? দু-জনেই শিশুপাল সাজবে নাকি?
–আহা, তা কেন! এক জন সাজবে শিশুপাল, অন্য জনকে দ্বিতীয় পাণ্ডব করে দেব বলে এসেছি।
বিভুদা তো থ! দ্বিতীয় পাণ্ডব?
—হ্যাঁ, তাতে অত অবাক হবার কী আছে? তোকে তেমন মানাচ্ছিল না, তা ছাড়া তোর তো আরও চারটে পার্ট আছে। আর অন্য দিকেও অনেক কাজ থাকবে, লোকজন আসবে
বিভুদা থমথমে মুখ করে বললে, সেগুলো তো আর ঠিক কথা-বলা পার্ট নয়, শুধু সেজে গুঁজে ঘুরে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে যে আজ্ঞে বলা। সে আমার দরকার নেই, আমি চলি।
ছোটকা ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ও আবার কী বিভু? দু-জনকেই পার্ট না দিলে যে কেউই আসবে না। তুই বাড়ির ছেলে তুই এইটুকু ছাড়তে পারবি নে? ওসব পারিসও না তো ভালো!
শুনে বিভুদা রেগেমেগে চলে যায় আর কী! বড়দা মেজদা তখন মাঝখানে পড়ে বললে, আরে, অত রাগারাগির কী আছে রে বিভু? মেরে তো ওদের তাড়িয়েই দিয়েছিস, ওরা তো আর পার্ট কত্তে আসছে না!
ছোটকা শুনে হতভম্ব!
–মেরে তাড়িয়ে দিযেছে! তার মানে? আমি তাদের বলে-কয়ে পাঠালাম, রাত্রে খেয়ে যাবে বললাম, ওদের জন্য পরোটা কাবাব কিনে আনলাম, আর এখন মেরে তাড়িয়ে দিলেই হল কি না! যা, ফিরিয়ে আনগে যা।
বলে আগুনের ভাঁটার মতো চোখ করে কোমরে হাত দিয়ে বিভুদার সামনে গিয়ে ছোটকা দাঁড়ালেন। বাবা! দেখে আমারই কেমন বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এক বার তাকিয়ে বাড়ির ভিতের গায়ের ফুটোটার দিকেও তাকালাম, কালো-মাস্টার আছে তো ঠিক? বাইরে থেকে কিছু বুঝবার জো নেই।
আরও সব ছিল আশেপাশে। সব নিয়ে একুশটা কথা-বলা পার্ট, তা ছাড়া দাঁড়ানো পার্ট, জনতা– সে এক ব্যাপার! চাতালে তোক ধরে না। অথচ কারো পার্ট মুখস্থ নেই, ড্রেসের কিছু ঠিক নেই, দাড়ি-গোঁফ নেই, আর সবচেয়ে খারাপ হল শিশুপাল নেই। তারপর বিভুদা যদি রেগেমেগে দলবল নিয়ে চলে যায়, তাহলে তো আমার দ্বিতীয় সৈনিক সাজা ওইখানেই হয়ে গেল!
বড়দা, মেজদা, কুটুবাবু, ঘনাদা, ঘনাদার মামা আরও কারা কারা ছিল। তারা সবাই মিলে বললে, আহা, বটু ছাড়ান দাও, ছাড়ান দাও, যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন একটু চায়ের ব্যবস্থা করো দিকিনি। ততক্ষণ রিহার্সাল চলুক, তুমি বরং নিজেই শিশুপালের পার্টটা পড়ে দাও-না।
চমকে গেলাম। এ যে একেবারে কালো-মাস্টারের মুখের কথা। ছোটকা আমতা আমতা করে বললেন, না, মানে, আমি কী করে পড়ব, স্টেজ-ম্যানেজার কে হবে তাহলে?
আমি বললাম, কেন, বড়োকাকিমা হবেন। উনি তো সব জানেন।
অমনি বিভুদা পারলে আমাকে মারে আর কী!
–যা যা, তোকে অত ফোঁপরদালালি কত্তে হবে না। দাড়ি-গোঁফের কী ব্যবস্থা করেছিস? ঘাবড়ে চুপসে আমি এতটুকু হয়ে গেলাম। আমাকেই যে আবার দাড়ি-গোঁফ আনতে হবে তা মনে ছিল না। আবার মনে হল কালো-মাস্টার তো সবই শুনছে, তার সামনে আমাকে যা-তা বলবে আর আমি কিছু বলব না! চেঁচিয়ে বললাম, হা হা, বলেছি যখন তখন নিশ্চয়ই এনে দেব কোথাও থেকে।
ছোটকা তো হাঁ। বিভুদা বললে, কোথাও থেকে মানে? দাড়ি-গোঁফ কি গাছে হয় যে তুলে আনলেই হল? জ্যাঠামশাইকে লিখেছিস?
উঠে পড়ে বিভুদাকে বললাম, তুমি তোমার নিজের কাজ করো দেখি! দাড়ি-গোঁফ পেলেই হল তো!
ছোটকা বললেন, আঃ বিভু, কেবল ওর পেছনে লাগা। এখন কালকের মধ্যে একটা শিশুপাল ঠিক না হলে তো নাটক বন্ধ করে দিতে হবে! তুই এক বার নগা ভোলার কাছে গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে আনবি কি না বল!