বিভুদা বললে, আসলে ওই পার্টটাই তোকে দেবার কথা হয়েছিল, বেশ পালক-দেওয়া শিরস্ত্রাণ পরতে পেতিস। কিন্তু ছোটকা বলছে, তুই স্টেজে শুলে ফুটলাইটের ওপর দিয়ে তোকে দেখাই যাবে না, আর অস্ত্রশস্ত্রগুলোও বড্ড বড়ো।
খেয়ে উঠে কাগজে-লেখা পার্টটা পকেটে নিয়ে আবার ঘরে গিয়ে দোর দিলাম। সবাইকে বললাম ঘুম পাচ্ছে, কেউ যেন বিরক্ত না করে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, খিড়কির বাগানের দিকে স্নানের ঘরের দরজা খুলে তিন মিনিটে পেরিস্তানে পৌঁছে গেলাম।
দেখলাম কালোমাস্টারের মেজাজ ঠিক নেই বললে, এই অ্যাত্ত বেলা করে ওইরকম শুকনো খাবার আনলে? কই, আমার মাছ তরকারি ভাত কই? নিজে তো একরাশ গিলে এসেছ!
বললাম, অনেক কষ্টে এনেছি। খেতে হয় এই খাও, নয় তো উপোস করে থাকো, আমি চললাম। আমারও মন ভালো নেই।
বলে যেই উঠে দাঁড়িয়েছি, অমনি সে সটাং মাটিতে শুয়ে পড়ে আমার দু-পা জড়িয়ে ধরে বললে, খ্যামা দাও কত্তা, খিদের চোটে অন্যায় বলেছি! নয়তো দু-ঘা লাগিয়ে দাও, কিচ্ছুটি বলব না! কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি আবার বসলাম, আর সে সাপটে-সুপটে পাঁউরুটি, চপ, কলা সব খেয়ে ফেলল। ভেবেছিলাম বিকেলের জন্য কিছু রাখবে, তাও রাখল না। শেষটা বললাম, বিকেলে আমার রিহার্সাল আছে, রাতের আগে আসতে পারব না, তুমি বরং জলখাবারের সময় কুচো নিমকি আর মুড়ির মোয়া খেয়ো।
সে যেন আকাশ থেকে পড়ল।
–ওমা! মুড়ির মো আবার কোত্থেকে আসবে? সে তো আমি টিপিন খেয়েছি, তোমার দেরি দেখে!
পকেট থেকে আমার বাঁদর-বিস্কুটের ঠোঙাটা শেষপর্যন্ত দিতে হল। সে মহা খুশি হয়ে তখুনি দুটো বিস্কুট মুখে পুরে বলল, ওয়াঃ! এর সঙ্গে অমৃতের যে কোনো তপাত নেই, কত্তা! ও হ্যাঁ, রিহার্সালের কথা কী বলছিলে? দেখি পাটাখানা; দিয়ে দোব নাকি এইসা এক মওড়া যে সকলের তাক লেগে যাবে!
বললাম, মওড়া আবার কী?
সে তো অবাক!
–ওমা, নাটক করবে, মওড়া জান না? তালিম গো, তালিম! ওই যাকে বলে রিহার্সাল তাই আর কী।
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ও লোকটাই-বা অত কথা জানল কী করে?
০৬-১০. পুরো আধটি ঘণ্টা ধরে
পুরো আধটি ঘণ্টা ধরে আমাকে দ্বিতীয় সৈনিকের পার্ট শেখাল কালো-মাস্টার। বলল, ওতেও হল না, পাখি-পড়া করিয়ে ছেড়ে দেব কেমন দেখো। বাবা! তোমার থেকে কত বড়ো বড়ো বাহাদুরকে অমনি অমনি তৈরি করে দিয়েছি-না! পরে যখন তাদের পাখনা গজাল তখন আর আমার কথা মনে পড়ে না। সে যাক গে, আজ ওই ছাদাটা দিয়ে তোমাদের মওড়া দেখব। দেখো, কালো-মাস্টারের মান রেখো।
একগাল হেসে আমার দিকে তাকিয়ে সে আরও বললে, কী, হল কী কর্তা? আজ মুখটা অমন গোমড়া কেন? কেউ কিছু বলেছে নাকি? বলল তো তার মুণ্ডুটা ছিঁড়ে নিয়ে আসি।
তখন বলতে হল সব কথা–
–দেখো, আমাকে যা খুশি বলুকগে, তাতে আমার ততটা এসে যায় না। কিন্তু বিশেকে নিয়ে ওরা ওভাবে কথা বললে রাগে আমার গা জ্বলে যায়। বিশের বিষয় ওরা কী জানে যে যা-তা বলবে? তাকে দেখেছে কখনো?
কালো-মাস্টার গম্ভীর হয়ে গেল।
-কেউ দেখল না বিশেকে, শুধু একা তোমার সঙ্গে ভাব? হা গো কত্তা, অপরাধ নিয়ো না, কিন্তু অমন লুকিয়ে-চুরিয়ে সে আসেই-বা কেন? ভালোমানুষরা তো বুক ফুলিয়ে সোজা পথে আসে। শেষটা তোমাকে কোনো বিপদে ফেলে দেবে না তো?
শুনে আমি লাফিয়ে উঠলাম, কী যে বল কালো-মাস্টার! তুমি বিশেকে জান না তাই ও-রকম। বলছ। এ-বাড়ির লোকরা এত খারাপ, তা বিশে ওদের সঙ্গে মিশবে কেন? তা ছাড়া ওই সিংহ-না, ও তো খারাপ লোক দেখলেই তাকে কামড়ে-টামড়ে একাকার করে দেয়। কী করে আমাদের বাড়ির লোকদের সঙ্গে মিশবে শুনি? আমার মা কিংবা আমার ছোটোভাই নিমকি হলে অন্য কথা ছিল।
কালো-মাস্টার আমার আর-একটু কাছে ঘেঁষে বসে বলল, ও, তোমার মা ভাই তাহলে ওকে চেনে? তবে তো কোনো ভাবনা নেই!
–না, ঠিক চেনে না, মানে দেখেনি তো কখনো, চিনবে কোত্থেকে! তবে আমি বললেই বুঝবে বিশে কত ভালো। বিশে একবার একলা একটা ডাকাত ধরেছিল তা জান? ওদের দ্বীপের লোকরা সমুদ্রের তলা থেকে মুক্তো তুলে আনে, সেই মুক্তো একটা ঝুলিতে করে বিশে এখানে বিক্রি করতে এনেছিল। প্রাণে ভয় নেই বিশের, রাত্তির বেলায় অন্ধকার গলি দিয়ে একা যাচ্ছে, অমনি ডাকাত এসে দিয়েছে ঝুলিতে টান! আর যাবে কোথায়, অমনি ঘুরে দাঁড়িয়ে ধরেছে বিশে তাকে! ধরেই পিটিয়ে তাকে আধমরা করে ফেলেছে! তারপর তারই গামছা দিয়ে পাছমোড়া করে বেঁধে তাকে থানার উঠোনে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিল।
শুনে কালো-মাস্টারের চোখ ছানাবড়া!
–আঁ! অমনি ফেলে দিয়ে গেল? দারোগার কাছে জিম্মে করে দিল না? আবার যে ডাকাতি করবে।
–আরে না না, তাকে নাকে খত দিইয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল আর কখনো এমন কাজ করবে, করলে ওকে চুলচেরা করে দেওয়া হবে বলে শাসিয়ে রাখল। পাগল নাকি, আর ডাকাতি করে সে! বিশের ওই অসুরের মতো চেহারা দেখেই তার হয়ে গেছে! বিভুদা থেকে থেকে আমাকে ক্যাংলা বলে ডাকে, কিন্তু আমার বন্ধু বিশের সঙ্গে শুধু বিভুদা কেন, ছোটকা বিভুদা বড়দা মেজদা সবাই মিলেও পেরে উঠবে না।
এই বলে উঠে যাচ্ছি এমন সময় কালো-মাস্টার আমার হাতদুটো ধরে বললে, ও কত্তা, ওই শিশুপালের পার্টটা কে করবে বললে না?