কেবল বিদেশে নহে, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশেও অনেক বাঙ্গালী জ্ঞানবীর ও কর্ম্মবীর যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছেন। বাংলার বাহিরে নালন্দা ও বিক্রমশীল এই দুই প্রসিদ্ধ বৌদ্ধবিহারে অনেক বাঙ্গালী আচাৰ্য খ্যাতি লাভ করিয়াছেন ও সর্বাধ্যক্ষের পদ অলঙ্কৃত করিয়াছেন। চীনদেশীয় পরিব্রাজক হুয়েন সাং যখন নালন্দায় যান, তখন বাংলার ব্রাহ্মণ-রাজবংশীয় শীলভদ্র এই মহাবিহারের প্রধান আচাৰ্য্য ও অধ্যক্ষ ছিলেন। হুয়েন সাংয়ের বিবরণ হইতে শীলভদ্রের জীবনী সম্বন্ধে অনেক কথা জানিতে পারা যায়। শীলভদ্র ভারতের নানা স্থানে ঘুরিয়া বৌদ্ধধর্ম্মে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি নালন্দায় ভিক্ষুপ্রবর ধর্ম্মপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁহার নিকট দীক্ষা লাভ করেন। তাঁহার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি দূরদেশেও বিস্তৃত হইয়াছিল। এই সময় দাক্ষিণাত্যের একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মগধে আসিয়া ধর্ম্মপালকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করেন। শীলভদ্রের বয়স তখন মাত্র ৩০ বৎসর, কিন্তু ধর্ম্মপাল তাঁহাকেই ব্রাহ্মণের সহিত তর্ক করিতে আদেশ দিলেন। শীলভদ্র ব্রাহ্মণকে পরাজিত করিলেন। মগধের রাজা ইহাতে সন্তুষ্ট হইয়া শীলভদ্রকে একটি নগরের রাজস্ব উপহার দিলেন। ভিক্ষুর ধনলোভ উচিত নহে-এই যুক্তি দেখাইয়া শীলভদ্র প্রথমে ইহা প্রত্যাখ্যান করিলেন, কিন্তু রাজার সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া তিনি এই দান গ্রহণ করিলেন এবং ইহার দ্বারা একটি বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠা করিলেন। কালক্রমে হুয়েন সাং ৬৩৭ অব্দে নালন্দায় গমন করেন। তখন এখানে ছাত্রসংখ্যা ছিল দশ হাজার এবং বৌদ্ধগণের আঠারোটি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন। ধর্ম্মশাস্ত্র ব্যতীত বেদ, হেতুবিদ্যা, শব্দবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, ও সাংখ্য, প্রভৃতি এখানে অধীত হইত। হুয়েন সাং বলেন যে, এক শীলভদ্রই একা এই সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন এবং সংঘবাসীগণ তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাঁহার নাম উচ্চারণ না করিয়া তাহাকে ‘ধর্ম্মনিধি’ বলিয়া অভিহিত করিতেন। হুয়েন সাং চীনদেশ হইতে আসিয়াছেন শুনিয়া, শীলভদ্র তাঁহাকে সাদরে শিষ্যরূপে গ্রহণ করেন এবং যোগশাস্ত্র শিক্ষা দেন। আ ৬৫৪ অব্দে শীলভদ্রের মৃত্যু হয়।
শীলভদ্র ব্যতীত আরও দুইজন বাঙ্গালী-শান্তিরক্ষিত ও চন্দ্রগোমিন-নালন্দার আচাৰ্যপদ লাভ করিয়াছিলেন। শান্তিরক্ষিতের কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। চন্দ্রগোমিন বরেন্দ্রে এক ক্ষত্রিয়বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাহিত্য, ব্যাকরণ, ন্যায়, জ্যোতিষ, আয়ুর্ব্বেদ, সঙ্গীত ও অন্যান্য শিল্পকলায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন এবং আচাৰ্য অশোকের নিকট বৌদ্ধধর্ম্মে দীক্ষা লাভ করেন। তিনি প্রথমে দাক্ষিণাত্য ও সিংহল-দ্বীপে বাস করেন এবং চান্দ্র-ব্যাকরণ নামে একখানি ব্যাকরণগ্রন্থ রচনা করেন। তিনি নালন্দায় গমন করিলে, প্রথমে তথাকার আচাৰ্য্যগণ তাঁহার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন নাই। কিন্তু নালন্দার প্রধান আচাৰ্য্য চন্দ্রকীৰ্ত্তি তাঁহার পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হন। তিনি নালন্দায় একটি শোভাযাত্রার ব্যবস্থা করেন। ইহার সম্মুখভাগে তিনখানি রথ ছিল। ইহার একখানিতে চন্দ্রগোমিন আর একখানিতে মঞ্জুশ্রীর মূর্ত্তি, এবং তৃতীয়খানিতে স্বয়ং চন্দ্রকীর্তি ছিলেন। ইহার পর হইতে নালন্দায় চন্দ্রগোমিনের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি বাড়িয়া যায় এবং যোগাচার-মতবাদ সম্বন্ধে বিচার-বিতর্ক করিয়া তিনি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
নালন্দার ন্যায় বিক্রমশীল বিহারেও অনেক বাঙ্গালী আচাৰ্য্য ছিলেন। দীপঙ্করের কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। অভয়াকরগুপ্ত এই মহাবিহারের সর্বাধ্যক্ষের পদ লাভ করিয়াছিলেন এবং তিনি এখনো তিব্বতে একজন পঞ্ছেন-রিণপোছে অর্থাৎ রাজগুণালঙ্কৃত লামারূপে পূজিত হন। গৌড় নগরীর নিকটে তাঁহার জন্ম হয় এবং তিনি বৌদ্ধ পণ্ডিতরূপে খ্যাতিলাভ করেন। তিনি প্রথমে রামপালের রাজপ্রাসাদে বৌদ্ধ আচাৰ্য নিযুক্ত হন এবং ওদন্তপুরী বিহারের মহাযান সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব লাভ করেন। কালক্রমে তিনি বিক্রমশীল মহাবিহারের প্রধান আচার্য পদে নিযুক্ত হন। ঐ বিহারে তখন তিন হাজার ভিক্ষু বাস করিতেন। তিনি তিব্বতে গিয়াছিলেন কি না সঠিক বলা যায় না, কিন্তু বহু গ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদ করিয়াছিরেন। রামপালের রাজ্যাবসানের পূর্ব্বেই তাঁহার মৃত্যু হয়। তাঁহার সম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তিনি দিবসের প্রথম দুইভাগে শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করিতেন, তৃতীয় ভাগে ধৰ্ম্মব্যাখ্যা করিতেন এবং তারপর দ্বিপ্রহর রাত্রি পর্য্যন্ত হিমবন শ্মশানে দেবার্চনা করিয়া শয়ন করিতেন। সুখবতী নগরীর বহু ক্ষুধিত ভিক্ষুককে তিনি অন্নদান করেন। চরসিংহ নগরের এক চণ্ডাল রাজা একশত নরবলী দিবার সংকল্প করেন, কিন্তু তাঁহার অনুরোধে প্রতিনিবৃত্ত হন। একবার একদল ‘তুরুষ্ক’ ভারতবর্ষ আক্রমণ করিলে তিনি কয়েকটি ধর্ম্মানুষ্ঠান করেন এবং তাঁহার ফলে তুরুষ্কেরা ভারতবর্ষ ছাড়িয়া যাইতে বাধ্য হয়। অবশ্য এই গল্পগুলি কত দূর সত্য বলা কঠিন।
তিব্বতীয় লামা তারনাথ জেরি নামক আর একজন বাঙ্গালী আচার্যের কিছু বিবরণ দিয়াছেন। জেরির পিতা ব্রাহ্মণ আচাৰ্য্য গর্ভপাদ বরেন্দ্রের রাজা সনাতনের গুরু ছিলেন। বরেন্দ্রেই জেতারির জন্ম হয়। অল্প বয়সেই জ্ঞাতিগণ কর্ত্তৃক বিতাড়িত হইয়া জেরি বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রহণ করেন, এবং বৌদ্ধশাস্ত্রে, বিশেষত অভিধর্ম্মপিটকে, বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। রাজা মহাপাল (মহীপাল?) তাহাকে বিক্রমশীল বিহারের পণ্ডিত-এই গৌরবময় পদসূচক একখানি মানপত্র দান করেন। তিনি বহুদিন এই বিহারের আচাৰ্য্য ছিলেন এবং তাঁহার দুই ছাত্র রত্নাকরশান্তি ও দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পরে এই মহাবিহারের সাধ্যক্ষ পদ লাভ করিয়াছিলেন। তারনাথের মতে তিনি একশত গ্রন্থ রচনা করেন। ইহার অনেকগুলিই তিব্বতীয় ভাষায় অনূদিত হইয়াছিল।