.
৪. বাংলার শিল্পী
বাংলার শিল্পীগণের সম্বন্ধে আমরা বিশেষ কিছুই জানি না। তিব্বতীয় লামা তারনাথ লিখিয়াছেন যে, ধীমান ও তাঁহার পুত্র বিৎপালো প্রস্তর ও ধাতুর মূর্ত্তিগঠন এবং চিত্রাঙ্কনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং তাঁহাদের শিষ্য-প্রশিষ্যগণ একটি স্বতন্ত্র শিল্পী সম্প্রদায় গঠন করিয়াছিলেন। এই শিল্পীদ্বয়ের নির্ম্মিত কোনো মূৰ্ত্তি বা তাঁহাদের সম্বন্ধে অন্য কোনো বিবরণ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু বাংলায় যে শিল্পীসংঘ ছিল, বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিতে তাঁহার উল্লেখ আছে। ইহার ৩২টি অতিবৃহৎ পংক্তির অক্ষরগুলি যেরূপ সুন্দরভাবে পাথরে খোদিত হইয়াছে, তাহা উৎকৃষ্ট শিল্পকাৰ্য্য বলিয়া গণ্য করা যায়। যে শিল্পী ইহা উত্তীর্ণ করিয়াছিলেন, প্রশস্তির শেষ শ্লোকে তাঁহার পরিচয় আছে। তিনি ধর্ম্মের প্রপৌত্র, মনদাসের পৌত্র, বৃহস্পতিবার পুত্র, বরেন্দ্রের শিল্পীগোষ্ঠী-চূড়ামণি রাণক শূলপাণি। ইহা ইহতে অনুমিত হয় যে, বরেন্দ্রে (এবং সম্ভবত বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে) একটি শিল্পীসংঘ ছিল এবং শূলপাণি এই সংঘের প্রধান ছিলেন। রাণক এই উপাধি হইতে মনে হয় যে, তিনি রাজ্যের একজন সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন। কিন্তু ভট্টভবদেবের প্রায়শ্চিত্ত-প্রকরণ’ গ্রন্থ অনুসারে নৰ্ত্তক, তক্ষক, চিত্রোপজীবী, শিল্পী, রঙ্গোপজীবী, স্বর্ণকার ও কর্ম্মকার সমাজে হেয় বলিয়া পরিগণিত হইতেন, এবং কোনো ব্রাহ্মণ এই সমুদয় বৃত্তি অবলম্বন করিলে তাহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত। শূলপাণি সম্ভবত বংশানুক্রমে শিল্পীর কাৰ্য্য করিতেন। প্রস্তরে অক্ষর উত্তীর্ণ করাও যে প্রকৃত শিল্পীরই কাৰ্য্য ছিল, সিলিমপুরের প্রস্তরলিপির একটি শ্লোকে তাঁহার উল্লেখ আছে। এই লিপির উপসংহারে উক্ত হইয়াছে যে, প্রণয়ী যেমন তন্মনা হই বর্ণবিন্যাসে নিজের প্রণয়িনীর চিত্র অঙ্কিত করেন, শিল্পবিৎ সোমেশ্বর তেমনি এই প্রশস্তি লিখিয়াছিলেন। এই একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে শিল্পের প্রকৃতি ও অন্তর্নিহিত ভাবটি অতি সুন্দরভাবে ব্যক্ত হইয়াছে। গভীর অনুরাগ ও আসক্তিই যে শিল্পের প্রেরণা তাহা বাংলার শিল্পীগণ জানিতেন। বাংলার শিলালিপি ও তাম্রশাসন হইতে আমরা আরও কয়েকজন এইরূপ শিল্পীর নাম পাই যথা :
(১) ভোগটের পৌত্র, সুভটের পুত্র তাতট
(২-৩) সৎ-সমতট নিবাসী শুভ্রদাসের পুত্র মঙ্খদাস, ও তৎপুত্র বিমলদাস
(৪) সূত্রধর বিষ্ণুদ্র
(৫-৬) বিক্রমাদিত্য-পুত্র শিল্পী মহীধর ও তৎপুত্র শিল্পী শশীদেব
(৭) শিল্পী কর্ণভদ্র
(৮) শিল্পী তথাগতসার।
ইঁহাদের কয়েকজন স্পষ্টত শিল্পী উপাধিতে ভূষিত হইয়াছেন। মোটের উপর এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না যে, উল্লিখিত আটজন এবং শূলপাণি ও সোমেশ্বর প্রভৃতি যে কেবল প্রস্তর ও তাম্রপটে অক্ষর উৎকীর্ণ করিতেন তাহা নহে-তাহারা উচ্চশ্রেণীর শিল্পী ছিলেন এবং ধাতু ও প্রস্তরের মূর্ত্তি প্রভৃতিও গঠন করিতেন।
প্রস্তর ও ধাতুর মূৰ্ত্তিনির্মাণ ব্যয়সাপেক্ষ। সুতরাং অর্থশালী লোকই এই সমুদয় প্রতিষ্ঠা করিতেন। শিল্পীগণও এই সম্প্রদায়ের আদেশে এবং শাস্ত্রানুশাসন ও লোকাঁচারের নির্দেশমতো মূর্ত্তি প্রস্তুত করিতেন। ইহাতে তাহাদের শিল্পরচনার শক্তি ও স্বাধীনতা যে অনেক পরিমাণে খৰ্ব্ব হইত, তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। বিশেষত এই শিল্পীগণ যাঁহাদের অনুগ্রহে জীবিকা নির্বাহ করিতেন, শিল্পের সৌন্দৰ্যবোধ অপেক্ষা ধর্ম্মনিষ্ঠাই ছিল তাঁহাদের মনে অধিকতর প্রবল; সুতরাং বাংলার এই শিল্পীগণের পরিস্থিতি প্রকৃত শিল্পের উৎকর্ষের অনুকূল ছিল না। ইহা সত্ত্বেও তাহারা যে সূক্ষ্ম সৌন্দৰ্যবোধ ও দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন তাহাতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁহাদের মধ্যে শিল্পের একটি সহজ ও স্বাভাবিক অনুভূতি ছিল। ধনী ও অভিজাতবর্গের অনুগ্রহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পরিপুষ্ট এই সমুদয় শিল্পীর রচনা সমাজের উচ্চশ্রেণীর মনোরঞ্জন ও প্রয়োজনের অনুকূল হইত। লোকশিল্পের যে দৃষ্টান্ত পাহাড়পুর, ময়নামতী, মহাস্থান প্রভৃতি স্থানে পাওয়া যায়, পরবর্ত্তী যুগেও হয়তো তাহা ছিল, কিন্তু এযাবৎ তাঁহার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নাই।
২১. বাংলার বাহিরে বাঙ্গালী
একবিংশ পরিচ্ছেদ – বাংলার বাহিরে বাঙ্গালী
ভারতবাসীরা পূর্ব্ব এশিয়ায় ও পূর্ব্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে যে বিপুল বাণিজ্য-ব্যবসায়, বহু-সংখ্যক রাজ্য ও উপনিবেশ স্থাপন, এবং হিন্দু-সভ্যতার বহুল প্রচার করিয়াছিল, তাঁহার মধ্যে বাঙ্গালীর কৃতিত্ব কম ছিল না। এরূপ মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। স্থলপথে ভারতবর্ষ হইতে ঐ সমুদয় দেশে যাইতে হইলে, বঙ্গদেশের মধ্য দিয়াই যাইতে হইত। আৰ্য্যাবৰ্ত্ত হইতে যাহারা জলপথে যাইতেন, তাঁহারও তাম্রলিপ্তি বন্দরেই জাহাজে উঠিতেন। এই সমুদয় কারণে এবং বঙ্গদেশের লোকেরা সৰ্ব্বাপেক্ষা নিকটে থাকায়, তাহাদের পক্ষেই এরূপ যাতায়াতের সুবিধা বেশী ছিল।
এই সিদ্ধান্ত কেবল অনুমানমূলক নহে। ইহার প্রমাণস্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, ব্রহ্মদেশের প্রাচীন স্থাপত্যশিল্প যে প্রধানত বাঙ্গালীরই সৃষ্টি, পণ্ডিতেরা তাহা একবাক্যে স্বীকার করেন। প্রাচীন ব্রহ্মদেশের এক অঞ্চল গৌড় নামে অভিহিত হইত। মালয় উপদ্বীপের এক শিলালিপি হইতে রক্তমৃত্তিকাবাসী বুদ্ধগুপ্ত নামক এক মহানাবিকের কথা জানা যায়; পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে, এই রক্তমৃত্তিকা বা রাঙ্গামাটি বাংলায় অবস্থিত ছিল। শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজগণের গুরু ছিলেন একজন বাঙ্গালী, এবং যবদ্বীপে ও পার্শ্ববর্ত্তী অন্যান্য দ্বীপে বৌদ্ধধর্ম্মের প্রচার ও প্রসারে বাংলার যথেষ্ট প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়। শৈলেন্দ্ররাজগণের সহিত পালসম্রাট দেবপালের যে সৌখ্য ছিল, তাহা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। যবদ্বীপের কতকগুলি মূর্ত্তিতে উৎকীর্ণ লিপি তকালে বাংলা দেশে প্রচলিত অক্ষরে লিখিত। কাম্বোডিয়ার একখানি সংস্কৃত লিপিতে প্রাচীন গৌড়ীয় রীতির ছাপ এতই স্পষ্ট যে, কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে ইহার রচয়িতা হয় বাঙালি ছিলেন, নচেৎ বহুকাল বঙ্গদেশে থাকিয়া তথাকার সাহিত্যের অভিজ্ঞ হইয়াছিলেন। এই সমুদয় আলোচনা করিলে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, এশিয়ার পূর্ব্বখণ্ডে ভারতীয় রাজ্য ও সভ্যতা বিস্তারে বাঙ্গালীর প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।