বিহারৈলের বুদ্ধমূর্ত্তিতে বাংলার যে শিল্পধারার সূচনা দেখা যায়, পালযুগে তাঁহার কিরূপ বিকাশ হইয়াছিল, ঝেওয়ারিতে প্রাপ্ত বুদ্ধমূর্ত্তি (চিত্র নং ২৪) তাঁহার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। কিন্তু, সম্ভবত ব্ৰহ্মদেশের প্রভাবে, বুদ্ধমূর্ত্তির পরিকল্পনা কিরূপ পরিবর্তিত হইয়াছিল, ঝেওয়ারির আর একটি বুদ্ধমূৰ্ত্তি (চিত্র নং ২৫) হইতে তাহা জানা যায়। প্রাচীন মগধের শিল্পধারার সহিত বাংলার শিল্পী কিরূপ সুপরিচিত ছিল, শিববাটির বুদ্ধমূৰ্ত্তি (চিত্র নং ২৭ খ) তাঁহার চমৎকার দৃষ্টান্ত। বুদ্ধ শান্ত সমাহিতভাবে মন্দির-মধ্যে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট এবং তাঁহার চতুস্পার্শ্বে তাঁহার জীবনের প্রধান প্রধান ঘটনাবলী পৃথক পৃথক ক্ষুদ্র আকারে উৎকীর্ণ। গুপ্তযুগের সারনাথ শিল্পের প্রভাবে অনুপ্রাণিত হইলেও এইরূপ রচনাপ্রণালী মগধ ও বঙ্গের একটি বিশিষ্ট শিল্পকৌশল বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য।
কিন্তু কোনো কোনো বুদ্ধমূৰ্ত্তিতে এই সমুদয় বিদেশীয় প্রভাব বর্ত্তমান থাকিলেও বাংলার শিল্পী অনেক সময়ই বাংলার নিজস্ব শিল্পধারা অব্যাহত রাখিয়া সুন্দর বুদ্ধমূৰ্ত্তি গড়িয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ কলিকাতা যাদুঘরে রক্ষিত অবলোকিতেশ্বর (চিত্র নং ২১ খ) এবং ময়নামতীতে প্রাপ্ত মঞ্জুর বোধিসত্ত্বের (চিত্র নং ১৪) উল্লেখ করা যাইতে পারে। পূর্ব্বোক্ত খালিকৈরের তারামূৰ্ত্তির (চিত্র নং ১৩ ক) ন্যায় এই দুইখানির অনবদ্য মুখশ্রী, সাবলীল দেহভঙ্গী ও রচনাবিন্যাস উৎকৃষ্ট শিল্পের নিদর্শন।
.
৩. চিত্রশিল্প
পালযুগের পূর্ব্বেকার কোনো চিত্র অদ্যাবধি বাংলায় আবিষ্কৃত হয় নাই। কিন্তু খুব প্রাচীনকাল হইতেই যে এদেশে চিত্রাঙ্কনের চর্চ্চা ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। ফাহিয়ান তাম্রলিপ্তির বৌদ্ধবিহারে অবস্থানকালে বৌদ্ধমূর্ত্তির ছবি আঁকতেন। সুতরাং তখন তাম্রলিপ্তিতে যে চিত্রশিল্প পুরাতন ও সুপরিচিত ছিল, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।
সাধারণ মন্দির ও বৌদ্ধবিহার প্রভৃতির প্রাচীরগাত্র চিত্র দ্বারা শোভিত হইত। পরবর্ত্তীকালের শিল্পশাস্ত্রে স্পষ্ট এইরূপ অনুশাসন আছে এবং ভারতের অনেক স্থানে ইহার চিহ্ন এখনো বর্ত্তমান আছে। বাংলার অনেক মন্দির ও বিহারে সম্ভবত বহু চিত্র ছিল, মন্দির ও বিহারের সঙ্গেই তাহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে।
একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দে লিখিত কয়েকখানি বৌদ্ধ গ্রহের পুঁথিতে অঙ্কিত বজ্রযান-তন্ত্রযান মতোক্ত দেব-দেবীর ছবি ব্যতীত প্রাচীন বাংলার আর কোনো ছবি এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই। ইহার মধ্যে রামপালের রাজত্বের ৩৯শ বর্ষে ও হরিবর্ম্মার ১৯শ বর্ষে লিখিত দুইখানি অষ্টসাহস্রিকা-এবং হরিবর্ম্মার ৮ম বর্ষে লিখিত একখানি পঞ্চবিংশতিসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথি বাংলার প্রাচীন চিত্রবিদ্যা আলোচনার প্রধান অবলম্বন।
রেখাবিন্যাস ও বর্ণসমাবেশ এই দুয়ের উপরই চিত্রশিল্পের প্রতিষ্ঠা এবং এ দুয়ের প্রাধান্য অনুসারেই চিত্রের দুইটি প্রধান শ্রেণীবিভাগ কল্পিত হইয়াছে। অজন্তা ও এলোরার চিত্রশিল্পে এই দুই শ্রেণীরই চিত্র দেখা যায়, এবং পরবর্ত্তীকালে ভারতের সর্বত্রই ইহার প্রভার পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিম ভারতবর্ষের চিত্রে রেখাবিন্যাসই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, কিন্তু বাংলার চিত্রে বর্ণসমাবেশ ও রেখাবিন্যাস উভয়েরই প্রভাব পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। পশ্চিম ভারতের চিত্রের সহিত তুলনা করিলে ইহাও বুঝা যায় যে, বাংলার শিল্পী রেখাবিন্যাসে অধিকতর দক্ষতা দেখাইয়াছেন এবং ইহার সাহায্যে যে সৌন্দর্য্য ও মাধুর্যের অবতারণা করিয়াছেন, পশ্চিম ভারতের চিত্রে তাহা দুর্লভ। বাংলার এই চিত্রশিল্পের প্রভাব আসাম, নেপাল ও ব্রহ্মদেশে বিস্তৃত হইয়াছিল।
পরিকল্পনার দিক দিয়া বাংলার চিত্র ও প্রস্তরে উত্তীর্ণ মূর্ত্তির মধ্যে প্রভেদ বড় বেশী নাই। উভয়েরই বিষয়বস্তু ও রচনাপদ্ধতি, এমনকি ভঙ্গী ও অঙ্গসৌষ্ঠব, প্রায় একই প্রকারের। কেন্দ্রস্থলে মূল দেব-দেবী, এবং দুই পার্শ্বে আনুষঙ্গিক মূর্ত্তিগুলি ও কদাচিৎ অলঙ্কাররূপে ব্যবহৃত দৃশ্যাবলী। কেবল দুই-এক স্থলে মূল মূর্ত্তিটি এক পার্শ্বে উপবিষ্ট। এইসব চিত্রে প্রায় এক অর্ধে কেবল মূল মূর্ত্তিটি এবং অপর অর্ধে অন্য সব পারিপার্শ্বিক মূর্ত্তিগুলির সমাবেশ করিয়া মূল মূর্ত্তির প্রাধান্য সূচিত হইয়াছে।
রাজা রামপালের রাজত্বের ৩৯শ বর্ষে লিখিত অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথিখানিতে যে কয়েকটি ছবি আছে, তাহা বাংলার চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে। সাধারণ কয়েকটি বর্ণ এবং সূক্ষ্ম রেখাপাতের সাহায্যে শিল্পী এই সমুদয় চিত্রের মধ্যে একটি লীলায়িত মাধুৰ্য্য ও অনবদ্য সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করিয়া মধ্যযুগের শিল্পজগতে উচ্চস্থান অধিকারের যোগ্যতা অর্জন করিয়াছেন। বাংলার চিত্রশিল্পের নমুনা মুষ্টিমেয় হইলেও, ইহা যে স্বর্ণমুষ্টি তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে।
কেবলমাত্র রেখার সাহায্যে চিত্র-অঙ্কনে বাংলার শিল্পী কত দূর পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন, সুন্দরবনে প্রাপ্ত ডোম্মনপালের তাম্রশাসনের অপর পৃষ্ঠে উৎকীর্ণ বিষ্ণুর রেখাচিত্র তাঁহার দৃষ্টান্ত। প্রাচীন বাংলার তাম্রপটে উৎকীর্ণ এইরূপ আরও দুইটি রেখাচিত্র পাওয়া গিয়াছে।