এ পর্য্যন্ত যে সমুদয় আলোচনা করা হইয়াছে তাহা এই যুগের শিল্প সম্বন্ধে সাধারণভাবে প্রযোজ্য। কোনো কোনো মূর্ত্তিতে যে ইহার ব্যতিক্রম দেখা যাইবে তাহা বলাই বাহুল্য, কারণ কোনো দেশের অথবা কোনো যুগের শিল্পই কয়েকটি সাধারণ নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। পালযুগের শিল্প সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করিতে হইলে এই যুগের মূর্ত্তির সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয় আবশ্যক। বর্ত্তমান গ্রন্থে মূর্ত্তিগুলির বিস্তৃত বিবরণ বা আলোচনা সম্ভবপর নহে বলিয়াই আমরা সংক্ষেপে এই যুগের শিল্পের গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সাধারণ মন্তব্য করিয়াছি। এই সকল মন্তব্য বিশদ ও পরিস্ফুট করিবার জন্য কয়েকটি মূর্ত্তির উল্লেখ করিতেছি।
শিল্পের দিক দিয়া দেখিতে গেলে বিষ্ণু ও তাঁহার পারিপার্শ্বিক দেব-দেবীর মূৰ্ত্তিগুলিই প্রাধান্য লাভ করে। শিয়ালদির বিষ্ণুমূর্ত্তির মুখে শিল্পী বেশ একটু নূতনত্ব ও বৈশিষ্ট্য ফুটাইয়াছেন। বিষ্ণুর উপরের দুই হস্তের অঙ্গুলির বক্রভাব কোমলতা ও কমনীয়তার সূচক, যদিও চক্র ও গদা এই দুই সংহারকারী অস্ত্র ধরিবার সহিত তাঁহার সামঞ্জস্য নাই। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, দুই স্তম্ভের ন্যায় সমান্তরাল পদযুগলের উপর দণ্ডায়মান সরল রেখার ন্যায় দেহগঠন শিল্পীর কৌশলের অভাব নহে, কঠোর নিয়মানুবর্তিতাই সূচিত করে। পার্শ্বচারিণী দুইজনের বঙ্কিম দেহভঙ্গী হইতেও ইহা প্রমাণিত হয়। এই দুই পার্শ্বচারিণীর মূৰ্ত্তি লাবণ্য ও সুষমার সহিত গাম্ভীৰ্য্য ও ভক্তির সংমিশ্রণে অপরূপ শোভা ধারণ করিয়াছে। বজ্রযোগিনীর মৎস্যাবতার মূর্ত্তিতে (চিত্র নং ২০) বিষ্ণুর মুখের কমনীয় কান্তি, অধর-যুগলের হাসিরেখা ও দেহের সুডৌল গঠন এমন কৌশলে সম্পাদিত হইয়াছে যে, বিষ্ণুর অধোভাগ মৎস্যের আকার হইলেও এই অসঙ্গতি শিল্পের সৌন্দর্য্যের হানি করে নাই। বাঘাউরার প্রস্তরনির্ম্মিত (চিত্র নং ১৮) এবং সাগরদীঘি, রঙ্গপুর ও বগুড়ার ধাতুনির্ম্মিত বিষ্ণুমূৰ্ত্তি (চিত্র নং ২১ ঘ, ১৯) উচ্চশ্রেণীর শিল্পকলার নিদর্শন। মূর্ত্তিগুলির কৃত্রিম দাঁড়াইবার ভঙ্গীর সহিত পার্শ্বচারিণীগণের সহজ সাবলীল ভাব বিশেষভাবে তুলনীয়। দেওরা ও বাণগড়ের বিষ্ণুমূর্ত্তিও উচ্চাঙ্গের শিল্পকলার নিদর্শন। মুর্শিবাবাদ জিলার অন্তর্গত ঝিল্লির বরাহ অবতারের মূৰ্ত্তিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূৰ্ত্তির মুখ বরাহের হইলেও, মনুষ্যাকৃতি অধোভাগে শিল্পী অনবদ্য সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করিয়াছেন। বিক্রমপুর ও বীরভূমের অন্তর্গত পাইকোরে প্রাপ্ত দুইটি নরসিংহমূৰ্ত্তিও কেবলমাত্র দেহসৌষ্ঠবে উচ্চশ্রেণীর শিল্পে পরিণত হইয়াছে।
বাঘরার বলরামমূর্ত্তির মুখে শিল্পী একটি স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ছাপ দিয়াছেন। ইহার সরল অনাড়ম্বর পশ্চাদপটে মূল মূর্ত্তি এবং তাঁহার পার্শ্বচারিণী ও বাহনের মূর্ত্তি কয়টির সৌন্দৰ্য্য উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে। ছাতিন গ্রামের সরস্বতী মূৰ্ত্তির (চিত্র নং ২৩) অঙ্গসৌষ্ঠব, বসিবার ভঙ্গী ও অপূৰ্ব্ব মুখশ্রী, এবং তাঁহার পারিপার্শ্বিক মূর্ত্তি ও বিভূষণাদি উচ্চশ্রেণীর শিল্পের পরিচায়ক। নাগইল ও বিক্রমপুরে প্রাপ্ত দুইটি এবং কলিকাতা যাদুঘরে রক্ষিত (চিত্র নং ২৭ গ) গরুড়মূৰ্ত্তিতে শিল্পী যে দাস্য ও ভক্তির মাধুৰ্য্য প্রকটিত করিয়াছেন, তাহা যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচায়ক।
শিবমূৰ্ত্তির মধ্যে শঙ্করবাঁধার নটরাজ শিবের মূৰ্ত্তি (চিত্র নং ২২ গ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিবের তাণ্ডবনৃত্যের সহিত উর্দ্ধমুখ বৃষেরা উচ্ছ্বসিত নৃত্য শিল্পীর অপূৰ্ব্ব সৃজনশক্তির পরিচায়ক। নৃত্যের গতিভঙ্গী ও উদ্দামতা এই মূর্ত্তির মধ্য দিয়া অপরূপ রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। বরিশালে প্রাপ্ত ব্রঞ্জের শিবমূৰ্ত্তিতে (চিত্র নং ২৮ খ) শিল্পী একটি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটাইয়া তুলিয়াছেন এবং ধাতুমূৰ্ত্তির নিৰ্মাণকৌশল কত দূর উন্নতি লাভ করিয়াছিল, তাঁহার যথেষ্ট পরিচয় দিয়াছেন। গণেশপুরে প্রস্ফুটিত পদ্মের স্বাভাবিক আকৃতিতে শিল্পী সূক্ষ্ম সৌন্দৰ্যানুভূতি ও স্বাতন্ত্রের পরিচয় দিয়াছেন। বাংলায় চলিত কথায় কার্তিকই সৌন্দর্য্যের আদর্শ। উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত একটি ময়ূরবাহন কার্তিকে (চিত্র নং ২১ ক) শিল্পী এই সৌন্দর্যের পরিচয় দিয়াছেন। শেষোক্ত দুইটি মূৰ্ত্তিতেই অলঙ্কারের বাহুল্য দেখা যায়। শিল্পীর কৌশলে ইহা মূৰ্ত্তিদ্বয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করিয়াছে, কিন্তু নিকৃষ্ট শিল্পীর হস্তে এইরূপ প্রাচুর্যে সৌন্দর্য্যের হানি হয়।
ঈশ্বরীপুরীর গঙ্গামূৰ্ত্তি বাংলার এই যুগের শিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ইহার স্বাভাবিক লীলায়িত পদক্ষেপ ও বিশিষ্ট মুখশ্রী, এবং পার্শ্বচর মূর্ত্তি দুইটির সুন্দর সরল দেহভঙ্গী সমগ্র মূর্ত্তিটিকে অপরূপ সুষমা প্রদান করিয়াছে।
রাজসাহীর ইন্দ্রাণী (চিত্র নং ২২খ), বিক্রমপুরের মহাপতিসরা (চিত্র নং ২১ গ) এবং খালিকৈরের বৌদ্ধ তারাও (চিত্র নং ১৩ ক) এই শ্রেণীর সুন্দর মূর্ত্তি। কঠিন পাথরের মধ্য দিয়ে রক্তমাংসের দেহের কমনীয়তা ও নমনীয়তা ফুটিয়া উঠিয়াছে।
বাংলায় অনেকগুলি সূর্যমূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহার মধ্যে কয়েকখানিতে উচ্চাঙ্গ ও বিশিষ্ট শিল্পজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। যাত্রাপুরের সূর্যের মুখশ্রী (চিত্র নং ১৬ ক) এবং কোটালিপাড়া (চিত্র নং ১৭) ও চন্দ্রগ্রামের (চিত্র নং ১৬ খ) সূৰ্য্যমূর্ত্তির রচনা-বিন্যাস ও শান্ত-সমাহিত ভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।