মস্তিষ্কের গঠনপ্রণালী হইতেই নৃতত্ত্ববিদগণ মানুষের জাতি নির্ণয় করিয়া থাকেন। মস্তিষ্কের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত অনুসারে যে সমুদয় শ্রেণীবিভাগ কল্পিত হইয়াছে, তাঁহার মধ্যে প্রধান দুইটির নাম ‘দীর্ঘ-শির’ (Dolichocephalic) ও ‘প্রশস্ত-শির’ (Brachycephalic) বৈদিক আর্য্যগণ যে যে প্রদেশে প্রাধান্য স্থাপন করিয়াছিলেন, সেখানকার সকল শ্রেণীর হিন্দুগণ দীর্ঘ-শির। কিন্তু বাংলার সকল শ্ৰেণীর হিন্দুগণই প্রশস্ত-শির। কেহ কেহ অনুমান করেন যে পামির ও টাকলামাকান অঞ্চলের অধিবাসী হোমো-আলপাইনাস নামে অভিহিত একজাতীয় লোকই বাঙ্গালীর আদিপুরুষ। ইহাদের ভাষা আৰ্যজাতীয় হইলেও ইহারা বৈদিক ধর্ম্মাবলম্বী আৰ্য্যগণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। কিন্তু সকলে এই মত গ্রহণ করেন নাই।
মস্তিষ্কের গঠনপ্রণালী হইতে নৃতত্ত্ববিদগণ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে বাঙ্গালী একটি স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট জাতি। এমনকি বাংলা দেশের ব্রাহ্মণের সহিত ভারতের অপর কোনো প্রদেশের ব্রাহ্মণের অপেক্ষা বাংলার কায়স্থ, সদোপ, কৈবৰ্ত্ত প্রভৃতির সহিত সম্বন্ধ অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ।
বাংলার প্রাচীন নিষাদ জাতি প্রধানত কৃষিকাৰ্য্য দ্বারা জীবনযাপন করিত এবং গ্রামে বাস করিত। তাহারা নব্য প্রস্তর যুগের লোক হইলেও ক্রমে তাম্র ও লৌহের ব্যবহার শিক্ষা করিয়াছিল। সমতল ভূমিতে এবং পাহাড়ের গায়ে স্তরে স্তরে ধান্য উৎপাদন প্রণালী তাহারাই উদ্ভাবন করে। কলা, নারিকেল, পান, সুপারি, লাউ, বেগুন প্রভৃতি সজি এবং সম্ভবত আদা ও হলুদের চাষও তাহারা করিত। তাহারা গরু চড়াইত না এবং দুধ পান করিত না, কিন্তু মুরগী পালিত এবং হাতীকে পোষ মানাইত। কুড়ি হিসাবে গণনা করা এবং চন্দ্রের হ্রাসবৃদ্ধি অনুসারে তিথি দ্বারা দিন-রাত্রির মাপ তাহারাই এদেশে প্রচলিত করে।
নিষাদ জাতির পরে দ্রাবিড়ভাষাভাষি ও আপলাইন শ্রেণীভুক্ত এক জাতি বাংলা দেশে বাস ও বাঙ্গালী জাতির সৃষ্টি করে। পরবর্ত্তীকালে তাহারা নবাগত আৰ্যগণের সহিত এমন ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়া গিয়াছে যে তাহাদের পৃথক সত্তা ও সভ্যতা সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা করা কঠিন। কিন্তু আৰ্য্য উপনিবেশের পূর্ব্বে ভারতবর্ষের সভ্যতা কিরূপ ছিল, তাঁহার আলোচনা করিলে এই বাঙ্গালী জাতির সভ্যতা সম্বন্ধে কয়েকটি মোটামুটি সিদ্ধান্ত করা যায়। বর্ত্তমানকালে প্রচলিত হিন্দু ধর্ম্মের কয়েকটি বিশিষ্ট অঙ্গ-যেমন কৰ্ম্মফল ও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস, বৈদিক হোম ও যাগযজ্ঞের বিরোধী পূজাপ্রণালী, শিব, শক্তি ও বিষ্ণু প্রভৃতি দেব-দেবীর আরাধনা এবং পুরাণবর্ণিত অনেক কথা ও কাহিনী-তাহাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। অনেক লৌকিক ব্রত, আচার, অনুষ্ঠান, বিবাহ-ক্রিয়ায় হলুদ, সিন্দুর প্রভৃতির ব্যবহার, নৌকা নিৰ্মাণ ও অন্যান্য অনেক গ্রাম্য শিল্প এবং ধুতি শাড়ি প্রভৃতি বিশিষ্ট পরিচ্ছদ প্রভৃতিও এই যুগের সভ্যতার অঙ্গ বলিয়াই মনে হয়। মোটের উপর আৰ্যজাতির সংস্পর্শে আসিবার পূর্ব্বেই যে বর্ত্তমান বাঙ্গালী জাতির উদ্ভব হইয়াছিল এবং তাহারা একটি উচ্চাঙ্গ ও বিশিষ্ট সভ্যতার অধিকারী ছিল এই সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত বলিয়া গ্রহণ করা যায়।
.
২. আৰ্য প্রভাব
বৈদিক যুগের শেষভাবে অথবা তাঁহার অব্যবহিত পরেই বাংলা দেশে আৰ্য্য উপনিবেশ ও আৰ্য সভ্যতা বিস্তারের পরিচয় পাওয়া যায়। বৈদিক ধৰ্ম্মসূত্রে বাংলা দেশ আৰ্য্যাবর্তের বাহিরে বলিয়া গণ্য হইলেও মানবধর্ম্মশাস্ত্রে ইহা আৰ্য্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত এবং পুণ্ড জাতি পতিত ক্ষত্রিয় বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। মহাভারতে কিন্তু পুণ্ডু ও বঙ্গ এই উভয় জাতিই ‘সুজাত’ ক্ষত্রিয় বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। জৈন উপাঙ্গ পশ্লবণা (প্রজ্ঞাপন) গ্রন্থে আৰ্যজাতির তালিকায় বঙ্গ এবং রাঢ়ের উল্লেখ আছে। মহাভারতের তীর্থযাত্রা অধ্যায়ে করতোয়া নদীর তীর ও গঙ্গা-সাগরসঙ্গম পবিত্র তীর্থক্ষেত্র বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। রামায়ণেও সমৃদ্ধ জনপদগুলির তালিকায় বঙ্গের উল্লেখ আছে।
পুরাণ ও মহাভারতে বর্ণিত আছে যে দীর্ঘতমা নামে এক বৃদ্ধ অন্ধ ঋষি যযাতির বংশজাত পূৰ্ব্বদেশের রাজা মহাধাৰ্মিক পণ্ডিতপ্রবর সংগ্রামে অজেয় বলির আশ্রয় লাভ করেন এবং তাঁহার অনুরোধে তাঁহার রাণী সুদেষ্ণার গর্ভে পাঁচটি পুত্র উৎপাদন করেন। ইহাদের নাম অঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড, সুহ্ম ও বঙ্গ। তাহাদের বংশধরেরা ও তাঁহাদের বাসস্থানও ঐ ঐ নামে পরিচিত। অঙ্গ বর্ত্তমান ভাগলপুর, এবং কলিঙ্গ উড়িষ্যা ও তাঁহার দক্ষিণবর্ত্তী ভূভাগ। পু, সুহ্ম ও বঙ্গ যথাক্রমে বাংলার উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ ও পূৰ্ব্বভাগ। সুতরাং এই পৌরাণিক কাহিনী মতে উল্লিখিত প্রদেশগুলির অধিবাসীরা একজাতীয় এবং আৰ্য ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মিশ্রণে সমুদ্ভূত। এই কাহিনী ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করা যায় না কিন্তু ইহা মহাভারত ও পুরাণের যুগে বাংলা দেশে আর্য্যজাতির বিশিষ্ট প্রভাব সূচিত করে।
অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলা দেশেও উন্নত সভ্য অধিবাসীর সঙ্গে সঙ্গে আদিম অসভ্য জাতিও বাস করিত। মহাভারতে বাংলার সমুদ্রতীরবর্ত্তী লোকদিগকে ম্লেচ্ছ এবং ভাগবতপুরাণে সুহ্মগণকে পাপাশয় বলা হইয়াছে। আচারাঙ্গ সূত্র নামক প্রাচীন জৈন গ্রন্থেও পশ্চিমবঙ্গবাসীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার উল্লেখ আছে। তখন রাঢ় দেশ বজ্রভূমি ও সুহ্মভূমি এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর পথহীন এই দুই প্রদেশে ভ্রমণ করিবার সময় এখানকার লোকেরা তাঁহাকে প্রহার করে এবং তাহাদের ‘চুঁ চুঁ’ শব্দে উত্তেজিত হইয়া কুকুরগুলিও তাঁহাকে কামড়ায়। জৈন সন্ন্যাসীগণ অতিশয় খারাপ খাদ্য খাইয়া কোনোমতে বজ্রভূমিতে বাস করেন। কুকুর ঠেকাইবার জন্য সর্বদাই তাঁহারা একটি দীর্ঘ দণ্ড সঙ্গে রাখিতেন। জৈন গ্রন্থকার দুঃখ করিয়া লিখিয়াছেন যে রাঢ়দেশে ভ্রমণ অতিশয় কষ্টকর।