কাশ্মীরের ইতিহাস রাজতরঙ্গিণীতে পঞ্চগৌড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। কোন কোন গ্রন্থে বঙ্গদেশীয় গৌড়, সারস্বত দেশ (পঞ্জাবের পূর্বভাগ) কান্যকুব্জ, মিথিলা ও উৎকল—এই পাঁচটি দেশ একত্রে পঞ্চগৌড় বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। সম্ভবত গৌড়েশ্বর ধর্মপালের সাম্রাজ্য হইতেই এই নামের উৎপত্তি।
অষ্টম শতাব্দীতে রচিত অনর্ঘরাঘব নাটকে গৌড়ের রাজধানী চম্পার উল্লেখ আছে। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, এই চম্পানগরী বর্ধমানের উত্তর-পশ্চিমে দামোদর নদের তীরে অবস্থিত ছিল। কিন্তু অসম্ভব নহে যে, এই চম্পা প্রাচীন অঙ্গদেশের রাজধানী বৰ্তমান ভাগলপরের নিকটবতী প্রসিদ্ধ চাপানগরী হইতে অভিন্ন। কারণ একাদশ শতাব্দীর একখানি শিলালিপিতে অঙ্গদেশ গৌড়রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।
০২. বাঙ্গালী জাতি
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ –বাঙ্গালী জাতি
১. বাঙ্গালী জাতির উৎপত্তি
সর্বপ্রথম কোন সময়ে বাংলা দেশে মানুষের বসতি আরম্ভ হয়, তাহা জানিবার কোনো উপায় নাই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আদি যুগের মানব প্রস্তরনিৰ্মিত যে সমুদয় অস্ত্র ব্যবহার করিত, তাহাই তাহাদের অস্তিত্বের প্রধান প্রমাণ ও পরিচয়। সাধারণত এই প্রস্তরগুলি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। সর্বপ্রাচীন মানুষ প্রথমে যে সমুদয় পাষাণ-অস্ত্র ব্যবহার করিত, তাঁহার গঠনে বিশেষ কোনো কৌশল বা পারিপাট্য ছিল না, পরবর্ত্তী যুগে এই অস্ত্র সকল পালিস ও সুগঠিত হয়। এই দুই যুগকে যথাক্রমে প্রত্নপ্রস্তর ও নব্য প্রস্তর যুগ বলা যায়। নব্য প্রস্তর যুগে মানুষের সভ্যতা বৃদ্ধির আরও প্রমাণ পাওয়া যায়। তাহারা অগ্নি উৎপাদন করিতে জানিত, মাটি পোড়াইয়া বাসন নির্মাণ করিত এবং রন্ধনপ্রণালীতেও অভ্যস্ত ছিল। এই যুগের বহুদিন পরে মানুষ ধাতুর আবিষ্কার করে। মানুষ প্রথমে সাধারণত তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্রের ব্যবহার করিত বলিয়া এই তৃতীয় যুগকে তাম্রযুগ বলা হয়। ইহার পরবর্ত্তী যুগে লৌহ আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে মানুষ ক্রমে উন্নততর সভ্যতার অধিকারী হয়।
বাংলা দেশেও আদিম মানবসভ্যতার এইরূপ বিবর্ত্তন হইয়াছিল। কারণ এখানেও-প্রধানত পূর্ব্ব ও পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে-প্রত্ন ও নব্য প্রস্তর এবং তাম্রযুগের অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়াছে। বাংলা দেশের মধ্যভাগ অপেক্ষাকৃত পরবর্ত্তী যুগে পলিমাটিতে গঠিত হইয়াছিল। প্রস্তর ও তাম্রযুগে সম্ভবত বাংলার পার্ব্বত্য সীমান্ত প্রদেশেই মানুষ বসবাস করিতক্রমে তাহারা দেশের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে।
বৈদিক ধর্ম্মাবলম্বী আৰ্য্যগণ যখন পঞ্চনদে বসতি স্থাপন করেন তখন তাঁহার বহুদিন পরেও বাংলা দেশের সহিত তাঁহাদের কোনো ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না। বৈদিক সূত্রে বাংলার কোনো উল্লেখ নাই। ঐতয়ের ব্রাহ্মণে অনাৰ্য্য ও দস্যু বলিয়া যে সমুদয় জাতির উল্লেখ আছে, তাঁহার মধ্যে পুরে নাম দেখিতে পাওয়া যায়। এই পুণ্ড জাতি উত্তরবঙ্গে বাস করিত, তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গদেশের নিন্দাসূচক উল্লেখ আছে। বৈদিক যুগের শেষভাগে রচিত বৌধায়ন ধৰ্ম্মসূত্রেও পুণ্ডু ও বঙ্গদেশ বৈদিক কৃষ্টি ও সভ্যতার বহির্ভূত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে এবং এই দুই দেশে স্বল্পকালের জন্য বাস করিলেও আৰ্যগণের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে এইরূপ বিধান আছে।
এই সমুদয় উক্তি হইতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে বাংলার আদিম অধিবাসীগণ আর্য্যজাতির বংশসম্ভূত নহেন। বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ করিয়া পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন যে আর্য্যগণ এদেশে আসিবার পূর্ব্বে বিভিন্ন জাতি এদেশে বসবাস করিত। নৃতত্ত্ববিদগণও বর্ত্তমান বাঙ্গালীর দৈহিক গঠন পরীক্ষার ফলে এই সিদ্ধান্তই সমর্থন করিয়াছেন।
কিন্তু বাংলার অধিবাসী এই সমুদয় অনাৰ্যজাতির শ্রেণীবিভাগ ও ইতিহাস সম্বন্ধে সুধীগণ একমত নহেন। তাঁহাদের বিভিন্ন মতবাদের বিস্তৃত আলোচনা না করিয়া সংক্ষেপে এ সম্বন্ধে কিছু বলিলেই যথেষ্ট হইবে।
বাংলা দেশে কোল, শবর, পুলিন্দ, হাঁড়ি, ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি যে সমুদয় অন্ত্যজ জাতি দেখা যায়, ইহারাই বাংলার আদিম অধিবাসীগণের বংশধর। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে এবং বাহিরেও এই-জাতীয় লোক দেখিতে পাওয়া যায়। ভাষার মূলগত ঐক্য হইতে সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে এই সমুদয় জাতিই একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠীর বংশধর। এই মানবগোষ্ঠীকে ‘অস্ট্রো-এশিয়াটিক অথবা অষ্ট্রিক’ এই সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু কেহ কেহ ইহাদিগকে ‘নিষাদ জাতি’ এই আখ্যা দিয়াছেন। ভারতবর্ষের বাহিরের পূর্ব্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায় এই জাতির সংখ্যা এখনো খুব বেশী।
নিষাদ জাতির পরে আরও কয়েকটি জাতি এদেশে আগমন করে। ইহাদের একটির ভাষা দ্রাবিড় এবং আর একটির ভাষা ব্ৰহ্ম-তিব্বতীয়। ইহাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না।
এই সমুদয় জাতিকে পরাভূত করিয়া বাংলা দেশে যাঁহারা বাস স্থাপন করেন, এবং যাহাদের বংশধরেরাই প্রধানত বর্ত্তমানে বাংলার ব্রাহ্মণ, বৈদ্য কায়স্থ প্রভৃতি সমুদয় বর্ণভুক্ত হিন্দুর পূর্ব্বপুরুষ, তাঁহারা যে বৈদিক আর্য্যগণ হইতে ভিন্নজাতীয় ছিলেন, এ বিষয়ে পণ্ডিতগণের মধ্যে কোনো মতভেদ নাই। রিজলী সাহেবের মতে, মোঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে প্রাচীণ বাঙ্গালী জাতির উদ্ভব হইয়াছিল। কিন্তু এই মত এখন পরিত্যক্ত হইয়াছে। কোনো কোনো মোঙ্গোলীয় পার্ব্বত্য জাতি বাংলায় উত্তর ও পূর্ব্ব সীমান্তে বাস স্থাপন করিয়াছে কিন্তু এতদ্ব্যতীত প্রাচীন বাঙ্গালী জাতিতে যে মোঙ্গোলীয় রক্ত নাই, ইহা একপ্রকার সর্ব্ববাদীসম্মত। আর দ্রাবিড় নামে কোনো পৃথক জাতির অস্তিত্বই পণ্ডিতগণ এখন স্বীকার করেন না।