——————
* ইহার বিশেষ বিবরণ ষোড়শ পরিচ্ছেদের পঞ্চম ভাগে দ্রষ্টব্য।
৩। প্রাচীন জনপদ
পূর্বেই বলা হইয়াছে, হিন্দু যুগে সমগ্র বাংলা দেশের বিশিষ্ট কোনও নাম ছিল না এবং ইহার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। ইহার মধ্যে যে কয়টি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল, নিম্নে তাহদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিতেছি।
বঙ্গ
এই প্রাচীন জনপদ বর্তমান কালের দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ লইয়া গঠিত ছিল। সাধারণত পশ্চিমে ভাগীরথী, উত্তরে পদ্মা, পূর্বে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এবং দক্ষিণে সমুদ্র ইহার সীমারেখা ছিল; কিন্তু কোনও কোনও সময়ে যে ইহা পশ্চিমে কপিশা নদী ও পূর্বে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পূর্বতীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তাহারও প্রমাণ আছে। শিলালিপিতে ‘বিক্রমপুর’ ও ‘নাব্য’—প্রাচীন বঙ্গের এই দুইটি ভাগের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। বিক্রমপুর এখনও সুপরিচিত। নাব্য সম্ভবত বরিশাল ও ফরিদপুরের জলবহুল নিম্নভূমির নাম ছিল, কারণ এই অঞ্চলে নৌকাই যাতায়াতের প্রধান উপায়।
সমতট ও হরিকেল কখনও সমগ্র বঙ্গ এবং কখনও ইহার অংশ-বিশেষের নামস্বরূপ ব্যবহৃত হইত। হেমচন্দ্র তাঁহার অভিধানচিন্তামণি গ্রন্থে বঙ্গ ও হরিকেল একার্থবোধক বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন ; কিন্তু মঞ্জুশ্রীমূলকল্প নামক বৌদ্ধগ্রন্থে হরিকেল, সমতট ও বঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ডের নাম। আনুমানিক খৃষ্টীয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে লিখিত দুইখানি পুঁথিতে হরিকেল শ্রীহট্টের প্রাচীন নাম বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু জাপানে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মাদ্রিত একখানি মানচিত্র অনুসারে হরিকেল তাম্রলিপ্তির (বর্তমান তমলুক) দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। হুয়েংসাং সমতটের যে বর্ণনা করিয়াছেন, তাহাতে ইহাকে বঙ্গের সহিত অভিন্ন বলিয়াই মনে হয়। বঙ্গাল দেশও বঙ্গের এক অংশের নামান্তর। ইহার বিষয় পূর্বেই আলোচিত হইয়াছে। চন্দ্রদ্বীপ বঙ্গের অন্তর্গত আর একটি প্রসিদ্ধ জনপদ। ইহা মধ্যযুগের সুপ্রসিদ্ধ ‘বাকলা’ হইতে অভিন্ন এবং বাখরগঞ্জ জিলায় অবস্থিত ছিল। কেহ কেহ অনুমান করেন, প্রাচীন কালে এই স্থান ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত আরও অনেক ভূখণ্ডের নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ, এবং পূর্বে ইন্দোচীন হইতে আরম্ভ করিয়া পশ্চিমে মাদাগাস্কার পৰ্যন্ত অনেক হিন্দু উপনিবেশ এই নামে অভিহিত হইত। বৃহৎসংহিতায় উপবঙ্গ নামক জনপদের উল্লেখ আছে। ষোড়শ অথবা সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত দিগ্বিজয়প্রকাশ নামক গ্রন্থে যশোহর ও নিকটবতী ‘কানন-সংযুক্ত’ প্রদেশ উপবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে।
পুণ্ড্র ও বরেন্দ্রী
পুণ্ড্র একটি প্রাচীন জাতির নাম। ইহারা উত্তরবঙ্গে বাস করিত বলিয়া এই অঞ্চল পুণ্ড্রদেশ ও পুণ্ড্রবর্ধন নামে খ্যাত ছিল। এককালে পুণ্ড্রবর্ধন নামক ভুক্তি (দেশের সবোচ্চ শাসন-বিভাগ) গঙ্গা নদীর পূর্বভাগে স্থিত বর্তমান বাংলা দেশের প্রায় সমস্ত ভূখণ্ডকেই বুঝাইত, অর্থাং রাজসাহী, প্রেসিডেন্সি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম—বাংলার ভূতপূর্বে এই চারিটি বিভাগ কোন না কোন সময়ে পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির অন্তর্গত ছিল। পুণ্ড্রদেশের রাজধানীর নামও ছিল পুণ্ড্রবর্ধন। প্রাচীন কালে ইহা একটি প্রসিদ্ধ নগরী ছিল। বগুড়ার সাত মাইল দূরে অবস্থিত মহাস্থানগড়ই প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর ধংসাবশেষ বলিয়া পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, কারণ মৌর্য যুগের একখানি শিলালিপিতে এই স্থানটি পুণ্ড্রবর্ধন নগরী বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে।
বরেন্দ্র অথবা বরেন্দ্রী উত্তরবঙ্গের আর একটি সপ্রসিদ্ধ জনপদ। রামচরিত কাব্যে বরেন্দ্রীমণ্ডল গঙ্গা ও করতোয়া নদের মধ্যে অবস্থিত বলিয়া বণিত হইয়াছে।
রাঢ়া
ভাগীরথীর পশ্চিম তীরস্থিত রাঢ় অথবা রাঢ়াদেশ উত্তর ও দক্ষিণরাঢ়া এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। অজয় নদ এই দুই ভাগের সীমারেখা ছিল। রাঢ়াভূমি দক্ষিণে দামোদর এবং সম্ভবত রপনারায়ণ নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কোনও প্রাচীন গ্রন্থে গঙ্গার উত্তর ভাগও রাঢ়াদেশের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু সাধারণত রাঢ়াদেশ গঙ্গার দক্ষিণ ও পশ্চিমভাগেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাঢ়ার অপর একটি নাম সুহ্ম।
রাঢ়ার দক্ষিণে বর্তমান মেদিনীপুর অঞ্চলে তাম্রলিপ্তি ও দণ্ডভুক্তি এই দুইটি দেশ অবস্থিত ছিল। তাম্রলিপ্তি বর্তমান কালের তমলুক এবং দণ্ডভুক্তি সম্ভবত দাঁতন। এই দুইটি ক্ষুদ্র দেশ অনেক সময় বঙ্গ অথবা রাঢ়ার অন্তর্ভুক্ত বলিয়া গণ্য হইত।
গৌড়
গৌড় নামটি সুপরিচিত হইলেও ইহার অবস্থিতি সম্বন্ধে সঠিক কোন ধারণা করা যায় না। পাণিনি-সূত্রে গৌড়পুরের এবং কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে গৌড়িক স্বর্ণের উল্লেখ আছে। ইহা হইতে গৌড় নামক নগরী অথবা দেশের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয়; কিন্তু বাংলাদেশের কোন অংশ ঐ যুগে গৌড় নামে অভিহিত হইত, তাহা নির্ণয় করা যায় না। খুব সম্ভবত মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের একটি ক্ষদ্র বিভাগ প্রথমে গৌড়-বিষয় (জিলা) নামে পরিচিত ছিল এবং এই বিষয়টির নাম হইতেই গৌড়দেশ এই নামের উৎপত্তি হইয়াছে। শিলালিপির প্রমাণ হইতে অনুমিত হয় যে, ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই দেশ প্রায় সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সপ্তম শতাব্দীতে মুর্শিদাবাদের নিকটবর্তী কর্ণসুবৰ্ণ গৌড়ের রাজধানী ছিল এবং এই দেশের রাজা শশাঙ্ক বিহার ও উড়িষ্যা জয় করিয়াছিলেন। সম্ভবত এই সময় হইতেই গৌড় নামটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটকে রাঢ়াপুরী গৌড়ের অন্তর্গত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। মসলমান যুগের প্রারম্ভে মালদহ জিলার লক্ষ্মণাবতী গৌড় নামে অভিহিত হইত। বাংলার পরাক্রান্ত পাল ও সেন রাজগণের ‘গৌড়েশ্বর’ এই উপাধি ছিল। হিন্দুযুগের শেষ আমলে বাংলা দেশ গৌড় ও বঙ্গ প্রধানত এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, অর্থাৎ প্রাচীন রাঢ় ও বরেন্দ্রী গৌড়ের অন্তৰ্ভুক্ত হইয়া গিয়াছিল। মসলমান যুগের শেষভাগে গৌড়দেশ সমস্ত বাংলাকেই বুঝাইত।