কেহ কেহ অনুমান করেন, পাঁচ ছয় শত বৎসর পূর্বে পদ্মা নদীর অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু ইহা সত্য নহে। সহস্ৰাধিক বৎসর পূর্বেও যে পদ্মা নদী ছিল, তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ আছে। বৌদ্ধ চযাপদে * (৪৯ নং) পদ্মাখাল বাহিয়া বাঙ্গাল দেশে যাওয়ার উল্লেখ আছে। ইহা হইতে অনুমিত হয়, হাজার বছর আগে পদ্মা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র নদী ছিল। অসম্ভব নহে যে, প্রথমে খাল কাটিয়া ভাগীরথীর সহিত পূর্বাঞ্চলের নদীগুলির যোগ করা হয়; পরে এই খালই নদীতে পরিণত হয়। কারণ কলিকাতার নীচে গঙ্গা ও সরস্বতীর মধ্যে যে খাল কাটা হয়, তাহাই এখন প্রধান গঙ্গা নদীতে পরিণত হইয়া খিদিরপুরের নিকট দিয়া শিবপর অভিমুখে গিয়াছে, এবং কালীঘাটের নিকট আদিগঙ্গা প্রায় শুকাইয়া গিয়াছে। সে যাহাই হউক, ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বেই পদ্মা বিশাল আকার ধারণ করে। গত তিন চারিশত বৎসরে পদ্মা নদীর প্রবাহ-পথের বহর পরিবর্তন হইয়াছে এবং তাহার ফলে বহন সমদ্ধ জনপদ ও প্রাচীন কীর্তি বিনষ্ট হইয়াছে। সম্ভবত পূর্বে পদ্মা চলনবিলের মধ্য দিয়া বর্তমান ধলেশ্বরী ও বুড়ীগঙ্গার খাত দিয়া প্রবাহিত হইত। বুড়ীগঙ্গা এই নামটি হয়ত সেই যুগের স্মৃতি বহন করিতেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পদ্মার নিম্নভাগ বর্তমান কালের অপেক্ষা অনেক দক্ষিণে প্রবাহিত হইত, এবং ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জিলার মধ্য দিয়া চাঁদপুরের ২৫ মাইল দক্ষিণে দক্ষিণ-সাবাজপুরের উপরে মেঘনার সহিত মিলিত হইত। মহারাজ রাজবল্লভের রাজধানী রাজনগর তখন পদ্মার বামতীরে অবস্থিত ছিল। এই নগরীর নিকট দিয়া কালীগঙ্গা নদী পদ্মা হইতে মেঘনা নদী পর্যন্ত প্রবাহিত হইত। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পদ্মার জলস্রোত এই কালীগঙ্গার খাত দিয়া বহিয়া যাইতে আরম্ভ করে, এবং তাহার ফলে রাজবল্লভের রাজধানী রাজনগর এবং চাঁদরায় ও কেদাররায়ের প্রতিষ্ঠিত অনেক নগরী ও মন্দির ধ্বংস হয়। এই কারণে ইহার নাম হয় কীর্তিনাশা। তারপর পদ্মার আরও পরিবর্তন হইয়াছে এবং এখনও হইতেছে।
ব্ৰহ্মপুত্র নদ পুরাকালে গারো পাহাড়ের পাশ দিয়া দক্ষিণ-পূর্ব মুখে গিয়া ময়মনসিংহ জিলার মধুপুর জঙ্গলের মধ্য দিয়া ঢাকা জিলার পূর্বভাগে সোনারগাঁর নিকট ধলেশ্বরী নদীর সহিত মিলিত হইত। নারায়ণগঞ্জের নিকটবতী নাঙ্গলবন্দে প্রাচীন ব্রহ্মপুত্রের শুষ্কপ্রায় খাতে এখনও প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ হিন্দু অষ্টমী স্নানের জন্য সমবেত হয়। বৰ্তমানে ব্ৰহ্মপুত্রের জলপ্রবাহ সোজা দক্ষিণে গিয়া গোয়ালন্দের নিকট পদ্মার সহিত মিলিত হইয়াছে। এই অংশের নাম যমুনা।
তিস্তা (ত্রিস্রোতা) উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী। প্রাচীন কালে ইহা জলপাইগুড়ির নিকট দিয়া দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইয়া পরে তিনটি বিভিন্ন স্রোতে প্রবাহিত হইত। সম্ভবত এই কারণেই ইহা ত্রিস্রোতা নামে পরিচিত ছিল। পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে পুনর্ভবা এবং মধ্যে আত্ৰেয়ী নদীই এই তিনটি স্রোত। আত্ৰেয়ী নদী চলনবিলের মধ্য দিয়া করতোয়ার সহিত মিলিত হইত। করতোয়া এখন শুষ্কপ্রায়, কিন্তু এককালে ইহা খুব বড় নদী ছিল এবং ইহার তীরে বাংলার প্রাচীন রাজধানী পুণ্ড্রবর্ধন নগরী অবস্থিত ছিল। করতোয়ার জল পবিত্র বলিয়া গণ্য হইত এবং ‘করতোয়ামাহাত্ম্য’ গ্রন্থ এই পণ্য-সলিলা নদীর প্রাচীন প্রসিদ্ধির পরিচায়ক। ১৭৮৭ খৃস্টাব্দে ভীষণ জলপ্লাবনের ফলে ত্রিস্রোতার মূল নদী পূর্বখাত পরিত্যাগ করিয়া দক্ষিণ-পূর্বদিকে অগ্রসর হইয়া ব্ৰহ্মপুত্র নদের সহিত মিলিত হয়। এইরপে বৰ্তমান তিস্তা নদীর সৃষ্টি হয় এবং করতোয়া, পুনর্ভবা ও আত্ৰেয়ী ধ্বংসপ্রায় হইয়া উঠে। প্রাচীন কৌশিকী (বর্তমান কুশী) নদী এককালে সমস্ত উত্তরবঙ্গের মধ্য দিয়া দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হইয়া ব্ৰহ্মপুত্র নদে মিলিত হইত। ক্রমে পশ্চিমে সরিতে সরিতে ইহা এখন বাংলা দেশের বাহিরে পূর্ণিয়ার মধ্য দিয়া রাজমহলের উপরে গঙ্গানদীর সহিত মিলিত হইয়াছে।
এই সমুদয় সপরিচিত দৃষ্টান্ত হইতে দেখা যাইবে যে, গত পাঁচ ছয় শত বৎসরের মধ্যে বাংলার নদনদীর স্রোত কত পরিবর্তিত হইয়াছে। ইহার পূর্বে প্রাচীন হিন্দু যুগেও যে অনুরূপে পরিবর্তন হইয়াছে, তাহাও সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু এই পরিবর্তনের কোন বিবরণই আমাদের জানা নাই। সুতরাং সে যুগে এই সমুদয় নদনদীর গতি ও প্রবাহ কিরূপ ছিল, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত করিয়া কিছুই বলা চলে না। হিন্দু যুগের বাংলা দেশের ইতিহাস পাঠকালে একথা সকলকেই মনে রাখিতে হইবে যে, কেবলমাত্র বর্তমান কালের নদনদীর অবস্থানের উপর নির্ভর করিয়া এবিষয়ে কোনরূপ সিদ্ধান্ত করা যুক্তিযুক্ত হইবে না।
নদনদীর গতি ও প্রবাহ ব্যতীত অন্য প্রকার প্রাকৃতিক পরিবর্তনেরও কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। সুন্দরবন অঞ্চল যে এককালে সুসমৃদ্ধ জনপদ ও লোকালয়পূর্ণ ছিল, এরপ বিশ্বাস করিবার কারণ আছে। ফরিদপুর জিলার অন্তর্গত কোটালিপাড়ার বিল অঞ্চলে যে খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রসিদ্ধ নগরী, দুর্গ ও বন্দর ছিল, শিলালিপিতে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। গঙ্গা, পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র নদ উচ্চতর প্রদেশ হইতে মাটি বহন করিয়া দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গের বদ্বীপে যে বিস্তৃত নতুন নতুন ভূমির সৃষ্টি করিয়াছে, তাহার ফলেও অনেক গুরুতর প্রাকৃতিক পরিবর্তন হইয়াছে। সুতরাং নদনদীর ন্যায় বাংলার স্থলভাগও হিন্দু যুগে এখানকার অপেক্ষা অনেকটা ভিন্ন রকমের ছিল।