তিন বৎসর পূর্ব্বে যখন এই গ্রন্থ প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন গ্রন্থারম্ভে বাংলা দেশের নাম ও সীমা সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছিলাম, “পরিবর্ত্তনশীল রাজনৈতিক বিভাগের উপর নির্ভর করিয়া কোনো প্রদেশের সীমা ও সংজ্ঞা নির্ণয় করা যুক্তিযুক্ত নহে।” এই নীতির অনুসরণ করিয়া বঙ্গ-বিভাগ সত্ত্বেও এই ইতিহাসে বাংলা দেশের নাম ও সীমা সম্বন্ধে কোনো পরিবর্ত্তন করি নাই। যেখানে কোনো জিলা বা বিভাগের উল্লেখ আছে, সেখানেও অবিভক্ত বঙ্গে ইহা যেরূপ ছিল তাহাই বুঝিতে হইবে।
কিরূপে সুদূর প্রাচীনকাল, হইতে নানাবিধ বিবর্ত্তন ও পরিবর্ত্তনের ফলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা এক জাতিতে পরিণত হইয়াছিল, গ্রন্থশেষে তাঁহার আলোচনা করিয়াছি। বর্ত্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও এই অংশের কোনো পরিবর্ত্তন করি নাই। কারণ অতীতকালের বাঙ্গালী যে এক জাতি ছিল, ইহা ঐতিহাসিক সত্য। ভবিষ্যতের গর্ভে কী নিহিত আছে, তাহা কেহই বলিতে পারে না। যদি বর্ত্তমান বিভাগ চিরস্থায়ী হইয়া দুই বাংলার অধিবাসীর মধ্যে আচার, কৃষ্টি ও ভাষাগত গুরুতর প্রভেদেরও সৃষ্টি হয়, তথাপি বাঙ্গালীর এক জাতীয়তার ঐতিহ্য চিরদিনই বাঙ্গালীর স্মৃতির ভাণ্ডারে সমুজ্জ্বল থাকিবে। হয়তো অতীতেও এই স্মৃতি ভবিষ্যতের পথ-নির্ণয়ে সহায়তা করিবে। এই হিসাবে গ্রন্থের এই অংশ পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকতর প্রয়োজনীয় বলিয়াই মনে করি। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব্বেই গ্রন্থের এই অংশ রচিত হইয়াছিল। সুতরাং আশা করি কেহ ইহাকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আন্দোলন বা প্রচারকাৰ্য্য বলিয়া মনে করিবেন না।
ভট্টপল্লী-নিবাসী শ্ৰীযুক্ত ভবতোষ ভট্টাচার্য মহাশয় বল্লালসেন-রচিত ব্রতসাগর গ্রন্থের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন। এই জন্য আমি তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি।
গ্রন্থোক্ত অনেক মন্দির, মূর্ত্তি ও চিত্রের প্রতিকৃতি দেওয়া সম্ভবপর হয় নাই। ইহাতে এই সমুদয়ের বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করা কষ্টসাধ্য হইবে। যে সকল পাঠক এই সমুদয় প্রতিকৃতি, দেখিতে চান, তাহারা ঢাকা, রাজসাহী ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের চিত্রশালার এবং কলিকাতা ও আশুতোষ যাদুঘরের মুদ্রিত মূর্ত্তি-তালিকা, স্বর্গীয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত “Eastern Indian School of Mediaevel Sculpture’, কাশীনাত দীক্ষিতের “Excavations at Pahaarpur’, cat ক্র্যামরিস প্রণীত “Pala and Sena Sculptures of Bengal”. শ্রীসরসীকুমার সরস্বতী রচিত “Early Sculpture of Bengal” এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত “History of Bengal, Vol. I” প্রভৃতি গ্রন্থে প্রায় সমুদয় শিল্প-নিদর্শনের প্রতিকৃতিই পাইবেন। এই গ্রন্থে বর্ণনার সাহায্যে ঐ সমুদয় গ্রন্থের চিত্রগুলি আলোচনা করিলে, ইংরেজী-অনভিজ্ঞ পাঠকও বাংলার প্রাচীন সভ্যতা ও কৃষ্টির সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাঁহার অতীত শিল্পকলা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করিতে পারিবেন। সাধারণত যে সমুদয় চিত্র সুপরিচিত নহে-যেমন গোবিন্দভিটা ও ময়নামতীর পোড়া-ইট, চট্টগ্রামের বুদ্ধমূর্ত্তি প্রভৃতি-তাহাই অধিকসংখ্যায় এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করিয়াছি। এই জন্য অনেক অধিকতর সুন্দর কিন্তু সুপরিচিত মূৰ্ত্তি বাদ গিয়াছে।
ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ ১৮, ২৬, ১৫ (খ), ৩০ ও ৩১ সংখ্যক চিত্রের ব্লক ও ৪, ১০, ১৪, ১৬, ২৪, ২৫ সংখ্যক চিত্রের ফটো দিয়াছেন। আশুতোষ যাদুঘর কাশীপুরের সূৰ্য্যমূর্ত্তি এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কোটালিপাড়ার সূৰ্য্যমূৰ্ত্তির ব্লক দিয়াছেন। ইহাদের সকলের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি।
শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৪নং বিপিন লাল রোড
কলিকাতা
চৈত্র ১৩৫৫
.
প্রথম পরিচ্ছেদ : বাংলা দেশ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : বাঙ্গালী জাতি
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : প্রাচীন ইতিহাস
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : গুপ্ত-যুগ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায়
যষ্ঠ পরিচ্ছেদ : পালসাম্রাজ্য
সপ্তম পরিচ্ছেদ : পালসাম্রাজ্যের পতন
অষ্টম পরিচ্ছেদ : দ্বিতীয় পালসাম্রাজ্য
নবম পরিচ্ছেদ : তৃতীয় পালসাম্রাজ্য
দশম পরিচ্ছেদ : পালরাজ্যের ধ্বংস
একাদশ পরিচ্ছেদ : বৰ্ম্মরাজবংশ
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : সেনরাজবংশ
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : পাল ও সেনরাজগণের কাল-নির্ণয়
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : বাংলার শেষ স্বাধীন রাজ্য
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : রাজ্যশাসনপদ্ধতি
ষোড়শ পরিচ্ছেদ : ভাষা ও সাহিত্য
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : প্রথম খণ্ড-ধৰ্ম্মমত
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : সমাজের কথা
উনবিংশ পরিচ্ছেদ : অর্থনৈতিক অবস্থা
বিংশ পরিচ্ছেদ : শিল্পকলা
একবিংশ পরিচ্ছেদ : বাংলার বাহিরে বাঙ্গালী
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ : বাংলার ইতিহাস ও বাঙ্গালীজাতি
নিবেদনং
বাংলা লিপির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
০১. বাংলা দেশ – প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রথম পরিচ্ছেদ – বাংলা দেশ
নাম ও সীমা, প্রাকৃতিক পরিবর্তন, প্রাচীন জনপদ, বঙ্গ, পুণ্ড্র ও বরেন্দ্রী, রাঢ়া, গৌড়
ভারতবর্ষের প্রায় প্রতি প্রদেশেরই নাম ও সীমা কালক্রমে পরিবর্তিত হইয়াছে। শাসন-কার্যের সুবিধার জন্য এক ইংরেজ আমলেই একাধিকবার বাংলা দেশের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। এখন যে ভূখণ্ডকে আমরা বাংলা দেশ বলি, এই শতাব্দীর আরম্ভেও তাহার অতিরিক্ত অনেক স্থান ইহার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আবার সম্প্রতি বাংলা দেশ দুইভাবে বিভক্ত হইয়া দুইটি বিভিন্ন দেশে পরিণত হইয়াছে। সুতরাং এই পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বিভাগের উপর নির্ভর করিয়া বাংলা দেশের সীমা নির্ণয় করা যুক্তিযুক্ত নহে। মোটের উপর, যে স্থানের অধিবাসীরা বা তাহার অধিক সংখ্যক লোক সাধারণত বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলে, তাহাই বাংলা দেশ বলিয়া গ্রহণ করা সমীচীন। এই সংজ্ঞা অনুসারে বাংলার উত্তর সীমার হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত কয়েকটি পার্বত্য জনপদ বাংলার বাহিরে পড়ে। কিন্তু বর্তমান কালের পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ, আসামের অন্তর্গত কাছাড় ও গোয়ালপাড়া এবং বিহারের অন্তর্গত পূর্ণিয়া, মানভূম, সিংহভূম সাঁওতাল পরগণার কতকাংশ বাংলার অংশ বলিয়া গ্রহণ করিতে হয়। প্রাচীন হিন্দু যুগেও এই সমুদয় অঞ্চলে একই ভাষার ব্যবহার ছিল কিনা, তাহা সঠিক বলা যায় না। কিন্তু আপাতত আর কোনও নীতি অনুসারে বাংলা দেশের সীমা নির্দেশ করা কঠিন। সুতরাং বর্তমান গ্রন্থে আমরা এই বিস্তৃত ভূখণ্ডকেই বাংলা দেশ বলিয়া গ্রহণ করিব।