পরবর্ত্তী একশত বৎসরে পুরাতত্ত্ব আলোচনার ফলে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান যে কতদূর অগ্রসর হইয়াছিল, স্বর্গীয় রামপ্রসাদ চন্দ প্রণীত ‘গৌড়রাজমালা’ গ্রন্থখানি তাঁহার প্রমাণস্বরূপ গ্রহণ করা যাইতে পারে। এদেশের অনেকে বিশেষত প্রাচীণপন্থিগণ পুরাতত্ত্বকে ‘পাথুরে প্রমাণ’ বলিয়া উপহাস অথবা অবজ্ঞা করিয়া থাকেন। কিন্তু প্রাচীন ইতিহাসের উদ্ধারে ইহার মূল্য যে কত বেশী, ‘রাজাবলী’র সহিত ‘গৌড়রাজমালা’র তুলনা করিলেই তাহা বুঝা যাইবে।
‘গৌড়রাজমালা’ আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে লিখিত বাংলার প্রথম ইতিহাস। ১৩৩৯ সনে ইহা প্রকাশিত হয়। ইহার দুই বৎসর পরে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাণীত ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ প্রকাশিত হয়। নামে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ হইলেও, ইহা প্রকৃতপক্ষে বাংলা ও মগধের ইতিহাস।
উল্লিখিত দুইখানি গ্রন্থেই কেবলমাত্র রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। বাংলার একখানি পূর্ণাঙ্গ লিখিবার কল্পনা অনেকবার হইয়াছে। ১৯১২ খৃষ্টাব্দে বাংলার গভর্ণর লর্ড কারমাইকেল ইহার সূত্রপাত করেন, এবং পরবর্ত্তী ত্রিশ বৎসরে আরও দুই-একজন এইরূপ চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা ফলবতী হয় নাই। স্বর্গীয় দীনশেচন্দ্র সেন এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ‘বৃহৎ বঙ্গ’ নামে দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ একখানি বৃহৎ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন (১৩৪১ সন)। কিন্তু, অনেক মূল্যবান তথ্য থাকিলেও এই গ্রন্থ বাংলার ঐতিহাসিক বিবরণ হিসাবে বিদ্বজ্জনের নিকট সমাদর লাভ করে নাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতেই সর্বপ্রথমে বাংলার একখানি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস প্রকাশিত হয়। আমার সম্পাদনায় তিন বৎসর হইল ইহার প্রথম খণ্ড বাহির হইয়াছে। ইহাতে হিন্দু যুগের শেষ পর্য্যন্ত বাংলার ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। এই গ্রন্থ ইংরেজিতে লিখিত। যখন ইহার প্রথম পরিকল্পনা হয়, তখন আমার ইচ্ছা ছিল যে, ইংরেজী গ্রন্থ বাহির হইবার পরই ইহার একখানি বাংলা অনুবাদ প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এই গ্রন্থ রচনায় বহু বিলম্ব হওয়ার ফলে, ইহার প্রকাশের পূর্ব্বেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে অবসর গ্রহণ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ত্তমান কর্তৃপক্ষগণ যে সত্বর ইহার বঙ্গানুবাদের কোনো ব্যবস্থা করিবেন, তাঁহার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে না। সুতরাং বাংলা ভাষায় বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস এবং বাঙ্গালীর ধৰ্ম্ম, শিল্প ও জীবনযাত্রার অন্যান্য বিভাগের মোটামুটি বিবরণসংবলিত একখানি ক্ষুদ্র গ্রন্থের বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করিয়া এই ইতিহাস লিখিতে প্রবৃত্ত হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত বাংলার ইতিহাস যে এই গ্রন্থের আদর্শ ও প্রধান উপাদান, তাহা বলাই বাহুল্য।
এই গ্রন্থ সাধারণ বাঙ্গালী পাঠকের জন্য, সুতরাং ইহাতে যুক্তি-তর্ক দ্বারা ভিন্ন ভিন্নমতের নিরাস ও প্রমাণপঞ্জীযুক্ত পাদটীকা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করিয়াছি। যাহারা এই সমুদয় জানিতে চাহেন, তাঁহারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশিত ইংরেজী গ্রন্থখানি পাঠ করিতে পারেন। ইংরেজী ভাষায় অনভিজ্ঞ পাঠকের পক্ষে এই সমুদয় অনাবশ্যক, কারণ এ সম্বন্ধে প্রবন্ধ ও গ্রন্থগুলি প্রায় সবই ইংরেজী ভাষায় লিখিত।
হিন্দু যুগের বাংলা দেশ সম্বন্ধে যে সমুদয় তথ্য এ যাবৎ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাঁহারই সারমর্ম সংক্ষিপ্ত আকারে বাঙ্গালী পাঠকের নিকট উপস্থিত করিতেছি। যাঁহারা ইংরেজী ইতিহাসখানি পাঠ করিয়াছেন বা করিবেন, তাঁহাদের পক্ষে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ অনাবশ্যক। কিন্তু যাঁহাদের ঐ গ্রন্থ পাঠের সুযোগ, সুবিধা অথবা সময় নাই, তাঁহারা ইহা পাঠ করিলে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করিতে পারিবেন। অবশ্য এই ইতিহাসের অতি সামান্যই আমরা জানি। কিন্তু এই গ্রন্থপাঠে যদি বাঙ্গালীর মনে দেশের প্রাচীন গৌরব সম্বন্ধে ক্ষীণ ধারণাও জন্মে এবং বাঙ্গালী জাতির অতীত ইতিহাস জানিবার জন্য কৌতূহল ও আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, তাহা হইলে আমার শ্রম সার্থক মনে করিব।
শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার
৪নং বিপিন পাল রোড, কলিকাতা পৌষ, ১৩৫২
.
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হইয়াছে। ইহাতে প্রমাণিত হয় যে, বাঙ্গালীর মনে অতীত ইতিহাস জানিবার আগ্রহ জন্মিয়াছে। সাত শত বৎসর পরে বাঙ্গালী হিন্দু পরাধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত হইয়াছে। সুতরাং যে যুগের ইতিহাস এই গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা জানিবার আগ্রহ ক্রমেই বৃদ্ধি পাইবে, এরূপ ভরসা করা যায়। এই জন্যই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি করিয়া এই নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হইল।
এই সংস্করণে গ্রন্থখানি আদ্যোপান্ত পরিশোধিত করা হইয়াছে। প্রথম সংস্করণ মুদ্রিত হইবার পর বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে যে সমুদয় নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাও ইহাতে সন্নিবেশিত হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ হরিকেল ও চন্দ্রদ্বীপের অবস্থান, রাত উপাধিধারী নতুন এক রাজবংশ, ভবদের ভট্টের বালবলভীভুজঙ্গ উপাধির অর্থ, বল্লালসেনের গ্রন্থালয় এবং তাঁহার রচিত নূতন একখানি গ্রন্থ, ময়নামতী পাহাড়ে আবিষ্কৃত ভাস্কর্যের নিদর্শন, নূতন বাঙ্গালী বৈদ্যক গ্রন্থাকার প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে। ২৫ খানি নূতন ছবিও যোগ করা হইয়াছে।