কান্তিদেবের অনতিকাল পরেই লয়হচন্দ্রদেব কুমিল্লা অঞ্চলে রাজত্ব করেন। তাঁহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। কিন্তু চন্দ্ৰ উপাধিধারী এক বৌদ্ধ রাজবংশ দশম শতাব্দের শেষভাগে হরিকেলে রাজত্ব করিতেন। চন্দ্রদ্বীপ তাঁহাদের রাজ্যভুক্ত ছিল এবং সম্ভবত রাজবংশের উপাধি হইতেই এই নামকরণ হইয়াছিল। লামা তারনাথ চন্দ্রবংশীয় রাজাদের বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন কিন্তু তাঁহার মতে এই সকল রাজাই পালরাজগণের পূর্ব্ববর্ত্তী ছিলেন। দশম শতাব্দীতে বাংলায় যে চন্দ্রবংশ রাজত্ব করিতেন তাঁহাদের সহিত তারনাথ বর্ণিত চন্দ্রবংশের অথবা আরাকানে চন্দ্ৰ উপাধিধারী যে সমুদয় রাজগণ রাজত্ব করিয়াছেন তাহাদের কোনো সম্বন্ধ ছিল কি না তাহা অদ্যাবধি নির্ণীত হয় নাই। আলোচ্য চন্দ্রবংশের মাত্র দুইজন রাজার নাম এ পর্য্যন্ত জানা গিয়াছে–মহারাজাধিরাজ ত্রৈলোক্যচন্দ্র ও তাঁহার পুত্র মহারাজাধিরাজ শ্রীচন্দ্র। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পিতা সুবর্ণচন্দ্র ও পিতামহ পূর্ণচন্দ্রের সম্বন্ধে আমরা কেবলমাত্র এইটুকু জানি যে তাঁহারা অথবা তাহাদের পূর্ব্বপুরুষগণ রোহিতাগিরিতে রাজত্ব করিতেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্ৰই প্রথমে হরিকেলে ও চন্দ্রদ্বীপে একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। রোহিতাগিরি কোথায় ছিল ঠিক বলা যায় না। কেহ কেহ মনে করেন যে ইহাই বর্ত্তমানে রোটা গড় নামে পরিচিত। আবার কাহারও মতে কুমিল্লার নিকটবর্ত্তী লালমাই অথবা লালমাটি সংস্কৃত রোহিতাগিরিতে পরিণত হইয়াছে। চন্দ্রবংশের আদিম নিবাস পূর্ব্ববঙ্গে ছিল ইহাই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়। এই পর্য্যন্ত এ বংশের যে পাঁচখানি তাম্রশাসন পাওয়া গিয়াছে তাহা বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার হইতে প্রদত্ত। সুতরাং বিক্রমপুর তাঁহাদের রাজধানী ছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। বাংলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজধানী বিক্রমপুর সম্ভবত চন্দ্রবংশীয় রাজারাই প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীনকালে বঙ্গ ও বঙ্গাল বলিলে যে দেশ বুঝাইত ত্রৈলোক্যচন্দ্র ও শ্রীচন্দ্র তাঁহার রাজা ছিলেন। শ্রীচন্দ্র অন্তত ৪৪ বৎসর রাজত্ব করেন। সম্ভবত তাঁহার রাজ্যকালেই কলচুরিরাজ লক্ষ্মণরাজ বঙ্গাল দেশ আক্রমণ করেন।
একাদশ শতাব্দের প্রারম্ভে গোবিন্দচন্দ্র দক্ষিণ ও পূৰ্ব্ববঙ্গে রাজত্ব করিতেন। চোলরাজ রাজেন্দ্ৰচোলের লিপিতে তিনি বঙ্গাল দেশের রাজা বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন, কিন্তু বিক্রমপুরেও তাঁহার দ্বাদশ ও এয়োবিংশ রাজ্যাব্দের দুইখানি লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। গোবিন্দচন্দ্র সম্ভবত চন্দ্রবংশীয় রাজা, কিন্তু শ্রীচন্দ্রের সহিত তাঁহার কী সম্বন্ধ ছিল তাহা জানা যায় নাই।
উল্লিখিত আলোচনা হইতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে দ্বিতীয় গোপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালে পালরাজ্য তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হইয়াছিল। পূৰ্ব্ব ও দক্ষিণবঙ্গ অর্থাৎ বঙ্গ ও বঙ্গাল দেশে চন্দ্রবংশীয় রাজ্য, পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ রাঢ়া ও বরেন্দ্রে অথবা গৌড়ে কাম্বোজবংশীয় রাজ্য, এবং বিহার অর্থাৎ অঙ্গ ও মগধে পালবংশীয় রাজ্য। এতদ্ব্যতীত পশ্চিমবঙ্গে আরও দু-একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য ছিল, তাহা পরে আলোচিত হইবে। এই সময় পালরাজগণের পিতৃভূমি বিশাল বাংলা দেশে তাঁহাদের কোনো প্রকার অধিকার ছিল বলিয়া মনে হয় না।
চন্দ্রেল্ল ও কলচুরি রাজগণের প্রশস্তিতে যে বঙ্গ, বঙ্গাল, গৌড়, রাঢ়া, অঙ্গ প্রভৃতি রাজ্য জয়ের উল্লেখ আছে তাহা খুব সম্ভবত এই সমুদয় স্বাধীন খণ্ডরাজ্যের প্রতি প্রযোজ্য।
০৮. দ্বিতীয় পালসাম্রাজ্য
অষ্টম পরিচ্ছেদ –দ্বিতীয় পালসাম্রাজ্য
১. মহীপাল
দশম শতাব্দের শেষভাগে যখন পালরাজবংশ দুর্দশা ও অবনতির চরম সীমায় পৌঁছিয়াছিল তখন দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র মহীপাল পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন (আ ৯৮৮)। তাঁহার অর্দ্ধশতাব্দীব্যাপী রাজ্যকালে পালরাজবংশের সৌভাগ্যরবি আবার উদিত হইয়াছিল। তিনি বাংলায় বিলুপ্ত পিতৃরাজ্য উদ্ধার ও পুনরায় পালসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়া যে অতুল কীৰ্ত্তি অর্জন করিয়াছেন তাহা ইতিহাসে তাঁহাকে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে। বাংলা দেশ ধর্ম্মপাল ও দেবপালের নাম ভুলিয়া গিয়াছে কিন্তু ‘ধান ভানতে মহীপালের গীত’ প্রভৃতি লৌকিক প্রবাদ, দিনাজপুরের মহীপালদীঘি এবং মহীপাল, মহীপুর, মহীসন্তোষ প্রভৃতি স্থান আজিও মহীপালের স্মৃতি রক্ষা করিয়া আসিতেছে।
কুমিল্লা নিকটবর্ত্তী বাঘাউড়া ও নারায়ণপুর গ্রামে একটি বিষ্ণু ও একটি গণেশ মূর্ত্তির পাদপীঠে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ সংবৎসরে উত্তীর্ণ মহীপালের দুইখানি লিপি হইতে প্রমাণিত হয় যে সিংহাসনে আরোহণের ২-৩ বৎসরের মধ্যেই তিনি পূর্ব্ববঙ্গ পুনরাধিকার করিয়াছিলেন। উত্তর অথবা পশ্চিমবঙ্গ জয় না করিয়া তিনি পূৰ্ব্ববঙ্গে যাইতে পারেন নাই। তাঁহার রাজত্বের নবম বৎসরে উত্তীর্ণ বাণগড় লিপি হইতে প্রমাণিত হয় যে উত্তরবঙ্গ তাঁহার অধীন ছিল। সুতরাং রাজ্যারম্ভেই তিনি উত্তর ও পূৰ্ব্ববঙ্গ জয় করেন এই সিদ্ধান্ত অনায়াসে করা যাইতে পারে। বাণগড় লিপিতে উক্ত হইয়াছে যে মহীপাল ‘রণক্ষেত্রে বাহুদর্পপ্রকাশে সকল বিপক্ষ পক্ষ নিহত করিয়া অনধিকারী কর্ত্তৃক বিলুপ্ত পিতৃরাজ্যের উদ্ধার সাধন করিয়া, রাজগণের মস্তকে চরণপদ্ম সংস্থাপিত করিয়া, অবনিপাল হইয়াছিলেন।’ সভাকবির এই উক্তি যে ঐতিহাসিক সত্য সে বিষয়ে সন্দেহ করিবার কারণ নাই।