এই সমুদয় আক্রমণের ফলে পালরাজগণ ক্রমেই শক্তিহীন হইয়া পড়িলেন এবং বাংলা দেশের বিভিন্ন অংশে স্বাধীন খণ্ডরাজ্যের উদ্ভব হইল। চন্দেল্ল ও কলচুরি রাজবংশের সভাকবিরা যে অঙ্গ, রাঢ়া, গৌড় ও বঙ্গাল প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছেন তাহা সম্ভবত এইরূপ পৃথক পৃথক স্বাধীন রাজ্যের সূচনা করে। কিন্তু ইহার অন্যবিধ প্রমাণও আছে।
দ্বিতীয় গোপালের পুত্র দ্বিতীয় বিগ্রহপাল আ ৯৬০ হইতে ৯৮৮ অব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁহার পুত্র মহীপালের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে তিনি (মহীপাল) অনধিকারী কর্ত্তৃক বিলুপ্ত পিতৃরাজ্যের উদ্ধার সাধন করেন। সুতরাং দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালেই পালগণের পৈত্রিক রাজ্যের বিলোপ হইয়াছিল। উত্তরবঙ্গের একখানি শিলালিপি ও পশ্চিমবঙ্গের একখানি তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, এই সময়ে এই দুই প্রদেশে কাম্বোজবংশীয় রাজগণ রাজত্ব করিতেন। সুতরাং এই কাম্বোজ রাজগণই যে মহীপালের তাম্ৰশাসনোক্ত ‘অনধিকারী’ তাহা নিঃসন্দেহে স্বীকার করা যায়।
বাংলার এই কাম্বোজ রাজবংশের উৎপত্তি গভীর রহস্যে আবৃত। ইহার প্রতিষ্ঠাতা মহারাজাধিরাজ রাজ্যপাল কামোজ-বংশ-তিলক বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। তাঁহার রাণীর নাম ভাগ্যদেবী। তাঁহার পর তাঁহার দুই পুত্র নারায়ণপাল ও নয়পাল যথাক্রমে পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রিয় নামক নগরে নয়পালের রাজধানী ছিল।
বাংলার পালসম্রাট নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপালের কথা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। তাঁহার রাণীর নামও ভাগ্যদেবী। এইরূপ নামসাদৃশ্য হইতে এই দুই রাজ্যপালকে অভিন্ন মনে করা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাহা হইলে ‘কাম্বোজবংশ তিলক’ এই উপাধির সার্থকতা কী? কেহ কেহ অনুমান করেন যে পালসম্রাট রাজ্যপালের মাতা সম্ভবত কাম্বোজবংশীয়া রাজকন্যা ছিলেন এবং সেই জন্যই রাজ্যপাল কাম্বোজবংশ-তিলক বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। এরূপ মাতৃবংশ দ্বারা পরিচয়ের দৃষ্টান্ত অন্যান্য রাজবংশের ইতিহাসেও পাওয়া যায়। এই দুই রাজ্যপালের অভিন্নতা মানিয়া লইলে এই সিদ্ধান্ত করিতে হয় যে তাঁহার মৃত্যুর পর রাজ্যের এক অংশে (অঙ্গ ও মগধে) তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় গোপাল ও তৎপুত্র দ্বিতীয় বিগ্রহপাল ও অন্য অংশে (উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে) তাঁহার দুই পুত্র নারায়ণপাল ও নয়পাল যথাক্রমে রাজত্ব করেন। অন্যথা স্বীকার করিতে হয় যে রাজ্যপাল নামক কাম্বোজবংশীয় এক ব্যক্তি কোনো উপায়ে পালরাজগণের হস্ত হইতে উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গ অধিকার করিয়া একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন।
ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কামোজ জাতির আদি বাসস্থল। এই সুদূর দেশ হইতে আসিয়া কামোজ জাতি বাংলা দেশ জয় করিয়াছিল ইহা সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না। তিব্বতীয়েরা কোনো কোনো গ্রন্থে কাম্বোজ নামে অভিহিত হইয়াছে এবং কোনো কোনো তিব্বতীয় গ্রন্থে লুসাই পৰ্ব্বতের নিকটবর্ত্তী বঙ্গ ও ব্রহ্মদেশের সীমান্ত প্রদেশে অবস্থিত কাম্বোজ জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, যে কামোজ জাতি বাংলা দেশ জয় করিয়াছিল তাহা এ দুয়ের অন্যতম। কিন্তু কাম্বোজ জাতি যে বাংলা দেশ আক্রমণ করিয়া জয় করিয়াছিল এরূপ স্থির সিদ্ধান্ত করিবার কোনো কারণ নাই। পালরাজগণ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে সৈন্য সংগ্রহ করিতেন। দেবপালের লিপি হইতে জানা যায় যে, কাম্বোজ দেশ হইতে পালরাজগণের যুদ্ধ-অশ্ব সংগৃহীত হইত। সুতরাং অসম্ভব নহে যে কামোজদেশীয় রাজ্যপাল পালরাজাগণের অধীনে সৈন্য অথবা অন্য কোনো বিভাগে উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন এবং পালরাজগণের দুর্বলতার সুযোগে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। যে উপায়েই কাম্বোজ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হউক, দশম শতাব্দের মধ্যভাগে যে তাঁহাদের অধীনে উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গ একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হইয়াছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
বাংলার অন্যান্য অঞ্চলেও কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। মহারাজাধিরাজ কান্তিদেব হরিকেলে রাজত্ব করিতেন এবং তাঁহার রাজধানীর অথবা এক প্রধান নগরীর নাম ছিল বর্দ্ধমানপুর। হরিকেল বলিতে সাধারণত পূৰ্ব্ববঙ্গ বুঝায় কিন্তু ইহা বঙ্গের নামান্তররূপেও ব্যবহৃত হইয়াছে। সুতরাং কান্তি দেবের রাজ্য কোথায় এবং কত দূর বিস্তৃত ছিল বলা যায় না। যদি বর্দ্ধমানপুর সুপরিচিত বর্দ্ধমান নগরী হয় তাহা হইলে বলিতে হইবে যে কান্তিদেবের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও বিস্তৃত ছিল। কান্তিদেব বিন্দুরতি নাম্নী এক শক্তিশালী রাজার কন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন এবং সম্ভবত ইহাই তাঁহার সৌভাগ্যের মূল। কারণ তাঁহার পিতা বা পিতামহ রাজা ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। কান্তিদেব কোন সময়ে রাজত্ব করিয়াছিলেন তাহা সঠিক নির্ণয় করা যায় না। খুব সম্ভবত দেবপালের পরবর্ত্তী দুৰ্বল পালরাজগণের সময়েই তিনি পূর্ব্ববঙ্গে স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। পরে দক্ষিণ বাংলা ও সম্ভবত পশ্চিম বাংলার কিয়দংশও অধিকার করেন। দশম শতাব্দী হইতে যে বঙ্গাল রাজ্যের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় সম্ভবত কান্তিদেবই তাঁহার পত্তন করেন। কান্তিদেব বৌদ্ধ ছিলেন। তাঁহার বংশধরগণের সম্বন্ধে এ পৰ্য্যন্ত কিছুই জানা যায় নাই।