রাষ্ট্রকূটরাজ অমোঘবর্ষের লিপিতে উক্ত হইয়াছে যে অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধের অধিপতি তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন। আ ৮৬০ অব্দে অমোঘবর্ষ কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদীর মধ্যবর্ত্তী বেঙ্গি দেশ জয় করেন। সম্ভবত ইহার অনতিকাল পরেই তিনি পালরাজ্য আক্রমণ করেন। অঙ্গ বঙ্গ ও মগধের পৃথক উল্লেখ দেখিয়া মনে হয় যে এগুলি তখন পৃথক স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হইয়াছিল-কিন্তু এ অনুমান সত্য না-ও হইতে পারে। সম্ভবত পালরাজ পরাজিত হইয়াছিলেন-কিন্তু রাষ্ট্রকূটরাজ যে স্থায়ীভাবে এ দেশের কোনো অংশ অধিকার করিয়াছিলেন তাহা মনে হয় না। তবে এই পরাজয়ে পালরাজগণের খ্যাতি ও প্রতিপত্তির অনেক লাঘব হইয়াছিল এবং সম্ভবত এই সুযোগে উড়িষ্যার শুক্তিবংশীয় মহারাজাধিরাজ রণস্তম্ভ রাঢ়ের কিয়দংশ অধিকার করেন।
পালরাজ যখন এইরূপে দক্ষিণ দিক হইতে আগত শত্রুর আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত তখন প্রতীহাররাজ ভোজ পুনরায় আৰ্য্যাবর্তে স্বীয় প্রাধান্য স্থাপনের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। যত দিন দেবপাল জীবিত ছিলেন তত দিন তাঁহার চেষ্টা ফলবতী হয় নাই। কিন্তু নারায়ণপালের ন্যায় দুৰ্বল রাজার পক্ষে ভোজের গতিরোধ করা সম্ভবপর হইল না। ভোজ কলচুরি ও গুহিলোট রাজগণের সহায়তায় নারায়ণপালকে গুরুতররূপে পরাজিত করিলেন। পালসাম্রাজ্যের ধ্বংসের উপর প্রতীহার রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হইল। ভোজের পুত্র মহেন্দ্রপাল পুনরায় পালরাজ্য আক্রমণ করিয়া বিহার প্রদেশ অধিকার করেন। তারপর অগ্রসর হইয়া ক্রমে তিনি উত্তর বাংলায় স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করিলেন। বাংলা ও বিহারে মহেন্দ্রপালের যে সমুদয় লিপি পাওয়া গিয়াছে তাহাদের তারিখ ৮৮৭ হইতে ৯০৪ অব্দের মধ্যে। কলচুরিরাজ কোক্কলুও সম্ভবত এই সময়ে বঙ্গ আক্রমণ করিয়া ইহার ধনরত্ন লুণ্ঠন করেন।
এইরূপে নবম শতাব্দের শেষভাবে কেবলমাত্র আর্য্যাবর্তের বিস্তৃত সাম্রাজ্য নহে, পালরাজগণের নিজ রাজ্যও শত্রুর করতলগত হইল। নারায়ণপালের অক্ষমতা ব্যতীত হয়তো এইরূপ শোচনীয় পরিণামের অন্য কারণও বিদ্যমান ছিল। দেবপালের মৃত্যুর পর পালরাজবংশের গৃহবিবাদের কথা পূর্ব্বেই আলোচিত হইয়াছে। রাষ্ট্রকূটরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণ (আ ৮৮০-৯১৪) পালরাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। বিজিত কামরূপ ও উৎকলের রাজগণ এই সময়ে প্রবল হইয়া ওঠেন এবং সম্ভবত তাঁহাদের সহিতও নারায়ণপালের সংগ্রাম হইয়াছিল। এইরূপে আভ্যন্তরিক কলহ ও চতুর্দিকে বহিঃশত্রুর আক্রমণে পালরাজ্যের দুর্দশা চরমে পৌঁছিয়াছিল।
পালরাজগণ আৰ্য্যাবর্ত্ত ও দাক্ষিণাত্যের দুইটি প্রবল রাজবংশের সহিত বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হইয়া নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করিয়াছিলেন। বিগ্রহপাল কলচুর অথবা হৈহয় রাজবংশের কন্যা লজ্জাদেবীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও কলচুরিগণ নারায়ণপালের শত্রুপক্ষে যোগদান করিয়াছিল।
নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপাল রাষ্ট্রকৃটরাজ তুঙ্গের কন্যা ভাগ্যদেবীকে বিবাহ করেন। এই তুঙ্গ সম্ভবত দ্বিতীয় কৃষ্ণের পুত্র জগঙ্গ। এই বিবাহের ফলে পালরাজগণের কিছু সুবিধা হইয়াছিল কি না জানা যায় না। কিন্তু নারায়ণপালের সুদীর্ঘ রাজ্যের শেষে তিনি প্রতীহারগণকে দূর করিয়া পুনরায় বিহার ও বাংলায় স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
নারায়ণপালের মৃত্যুর পর যথাক্রমে তাঁহার পুত্র রাজ্যপাল (আ ৯০৮ ৯৪০) ও তৎপুত্র দ্বিতীয় গোপাল (আ ৯৪০-৯৬০) রাজত্ব করেন। পালরাজগণের সভাকবি লিখিয়াছেন যে রাজ্যপাল সমুদ্রের ন্যায় গভীর জলাশয় খনন ও পৰ্ব্বতের তুল্য উচ্চ মন্দির নির্মাণ করিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি রাজ্যপাল ও গোপালের কোনোরূপ বিজয়কাহিনীর উল্লেখ করেন নাই। রাজ্যপাল সম্ভবত নিরুদ্বেগে রাজত্ব করিতে পারিয়াছিলেন। কারণ তাঁহার রাজ্যের প্রারম্ভেই চিরশত্রু প্রতীহাররাজ রাষ্ট্রকূটরাজ ইন্দ্র কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিল। ইন্দ্র প্রতীহার রাজধানী কান্যকুব্জ অধিকার করিয়া লুণ্ঠন করিয়াছিল এবং প্রতীহাররাজ মহীপাল পলাইয়া কোনোমতে প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। এই নিদারুণ বিপর্যয়ের ফলে প্রতীহার রাজ্য ধ্বংসের পথে অগ্রসর হইল এবং পালরাজগণও অনেকটা নিরাপদ হইলেন।
কিন্তু শীঘ্রই অন্য শত্রুর আবির্ভাব হইল। পাল ও প্রতীহার সাম্রাজ্যের পতনের পরে আর্য্যাবর্তে নূতন নূতন রাজশক্তির উদয় হইল এবং ইহারা অনেকেই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাল, প্রতীহার ও অন্যান্য রাজ্যের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হইল। এইরূপে সর্বপ্রথমে মধ্যভারতের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে চন্দ্রাত্রেয় বা চল্লে রাজ্য প্রবল হইয়া ওঠে। চন্দেল্লরাজ যশোবৰ্মণ প্রসিদ্ধ কালঞ্জয় গিরিদুর্গ অধিকার করিয়া আৰ্য্যাবর্তে প্রাধান্য লাভ করেন এবং তাঁহার বিজয়বাহিনী কাশ্মীর হইতে বাংলা দেশ পর্য্যন্ত যুদ্ধাভিযান করে। চন্দেল্লরাজের সভাকবি লিখিয়াছেন যে যশোবর্ম্মণ গৌড়দিগকে উদ্যানলতার ন্যায় অবলীলাক্রমে অসি দ্বারা ছেদন করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পুত্র ধঙ্গ (আ ৯৫৪-১০০০) রাঢ়া ও অঙ্গদেশের রাণীকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন। এই সমুদয় শ্লেষোক্তি নিছক সত্য না হইলেও পালরাজগণ চন্দেল্লরাজ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন ইহাই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়। চন্দেল্লগণের ন্যায় কলচুরি রাজগণও দশ শতাব্দের মধ্যভাগে আর্য্যাবর্তে নানা দেশ আক্রমণ করেন। কলচুরিরাজ প্রথম যুবরাজ ও তাঁহার পুত্র লক্ষ্মণরাজ যথাক্রমে গৌড় ও বঙ্গাল দেশ জয় করেন বলিয়া তাহাদের সভাকবি বর্ণনা করিয়াছেন।