বাঙ্গালীর বাহুবলে আর্য্যাবর্তে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাই ধৰ্ম্মপাল ও দেবপালের রাজ্যের প্রধান ঐতিহাসিক ঘটনা। বাঙ্গালীর জাতীয় ইতিহাসে ইহার অনুরূপ শক্তি বা সমৃদ্ধির পরিচয় ইহার পূর্ব্বে বা পরে আর কখনো পাওয়া যায় নাই।
০৭. পালসাম্রাজ্যের পতন
সপ্তম পরিচ্ছেদ –পালসাম্রাজ্যের পতন
দেবপালের মৃত্যুর পর তিনশত বৎসর পর্য্যন্ত পালরাজবংশের ইতিহাস কবি-বর্ণিত “পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায়” অগ্রসর হইয়াছিল। উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চারিশত বৎসরকাল অতিবাহিত করিয়া অবশেষে এই প্রসিদ্ধ রাজ্য ও রাজবংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ইহাই স্বাভাবিককালের গতি। বরং এত সুদীর্ঘকাল রাজত্বের দৃষ্টান্ত আৰ্য্যাবর্তের ইতিহাসে অতি বিরল, নাই বলিলেও চলে।
দেবপালের মৃত্যুর পর বিগ্রহপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। দেবপাল ও বিগ্রহপালের সম্বন্ধ লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কাহারও মতে বিগ্রহপাল দেবপালের পুত্র। কিন্তু অধিকাংশ পণ্ডিতগণই মনে করেন যে বিগ্রহপাল ধৰ্ম্মপালের ভ্রাতা বাপালের পৌত্র ও জয়পালের পুত্র। এই মতই সমীচীন বলিয়া বোধ হয় এবং বিগ্রহপালের পুত্র নারায়ণপালের তাম্রশাসনে পালরাজগণের যে বংশাবলী বিবৃত হইয়াছে তাহাও এই মতের সমর্থন করে। ইহাতে তৃতীয় শ্লোকে ধর্ম্মপালের বর্ণনার পরে চতুর্থ শ্লোকে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বাপালের ও পঞ্চম শ্লোকে তাঁহার পুত্র জয়পালের উল্লেখ আছে। এই শ্লোকে কথিত হইয়াছে যে জয়পাল ধর্ম্মদ্বেষিগণকে যুদ্ধে বশীভূত করিয়া পূৰ্ব্বজ দেবপালকে ভুবনরাজ্যসুখের অধিকারী করিয়া দিয়াছিলেন। পরবর্ত্তী ষষ্ঠ শ্লোকে জয়পাল কর্ত্তৃক উকল ও কামরূপ জয় বর্ণিত হইয়াছে। সপ্তম শ্লোকে বলা হইয়াছে তাঁহার অজাতশত্রুর ন্যায় বিগ্রহপাল নামক পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সংস্কৃতি রচনানীতি অনুসারে তাঁহার এই সর্বনাম শব্দ নিকটবর্ত্তী বিশেষ্য পদকেই সূচিত করে। সুতরাং পঞ্চম ও সপ্তম শ্লোকের ‘তাঁহার’ এই সর্বনাম শব্দ যথাক্রমে বাপাল ও জয়পাল সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইয়াছে ইহাই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়। অতএব বাপালের পুত্রই যে জয়পাল, এবং জয়পালের পুত্র বিগ্রহপাল, উক্ত দুই শ্লোক হইতে এইরূপ সিদ্ধান্ত হয়। অপর পক্ষ বলেন যে, দেবপাল জয়পালের পূৰ্ব্বজ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন, সুতরাং জয়পাল দেবপালের কনিষ্ঠ সহোদর অর্থাৎ ধর্ম্মপালের পুত্র। অতএব পঞ্চম ও সপ্তম শ্লোকের ‘তাঁহার’ এই সৰ্ব্বনাম শব্দ যথাক্রমে ধর্ম্মপাল ও দেবপালের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। এই যুক্তি সঙ্গত বলিয়া মনে হয় না, কারণ পূৰ্ব্বজ শব্দে কেবল জ্যেষ্ঠ বুঝায়, জ্যেষ্ঠ সহোদর অর্থ গ্রহণ করিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। অপর পক্ষে ইহাও বিবেচ্য যে ধর্ম্মপাল বা দেবপালের তাম্রশাসনে বাপালের বা জয়পালের কোনো উল্লেখ নাই, সহসা নারায়ণপালের তাম্রশাসনে তাঁহাদের এই গুণ-ব্যাখ্যানের হেতু কী? ইহার একমাত্র সঙ্গত কারণ এই মনে হয় যে বিগ্রহপাল ও তাঁহার বংশধরগণ দেবপালের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী ছিলেন না, সুতরাং তাঁহাদের পূর্ব্বপুরুষগণের কৃতিত্ব দ্বারাই তাঁহাদের সিংহাসন অধিকারের সমর্থন করার প্রয়োজন ছিল। অন্যথা তিন পুরুষ পরে এই প্রাচীন কীর্তিগাথা উদ্ধারের আর কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না।
দেবপালের কোনো পুত্র না থাকায় বিগ্রহপাল পিতৃব্যের সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন ইহা খুব সম্ভব বলিয়া মনে হয় না, কারণ দেবপালের রাজ্যের ৩৩ বর্ষে অর্থাৎ তাঁহার মৃত্যুর অনধিকাল পূর্ব্বের উৎকীর্ণ একখানি তাম্রশাসনে তাঁহার পুত্র রাজ্যপালের যৌবরাজ্যে অভিষেকের উল্লেখ আছে। অবশ্য পিতার জীবিতকালেই রাজ্যপালের মৃত্যু হইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু ইহাও অসম্ভব নহে যে সেনাপতি জয়পাল বৃদ্ধ রাজা দেবপালের মৃত্যুর পর অনুগত সৈন্যবলের সাহায্যে নিজের পুত্রকেই সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন। দেবপালের মৃত্যুর পরই যে পালরাজ্য ধ্বংসোন্মুখ হইয়াছিল হয়তো এই গৃহবিবাদই তাঁহার পথ প্রশস্ত করিয়া দিয়াছিল। কিন্তু এ সম্বন্ধে উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় নিশ্চিত কিছু বলা যায় না।
বিগ্রহপাল শূরপাল নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি শান্তিপ্রিয় ও সংসারবিরাগী ছিলেন। অল্পকাল (আ ৮৫০-৮৫৪) রাজ্য করিয়াই তিনি পুত্র নারায়ণপালের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করিয়া বানপ্রস্থ অবলম্বন করেন। নারায়ণপাল সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করেন (আ ৮৫৪-৯০৮)। তাঁহার ৫৪ রাজ্যসংবৎসরের একখানি লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। তিনিও পিতার ন্যায় উদ্যমহীন শান্তিপ্রিয় ছিলেন। কেদারমিশ্রের পুত্র গুরবমিশ্র তাঁহার মন্ত্রী ছিলেন। এই গুরবমিশ্রের লিপিতে ধর্ম্মপাল ও দেবপালের অনেক রাজ্যজয়ের উল্লেখ আছে। কিন্তু বিগ্রহপাল ও নারায়ণপাল সম্বন্ধে সেরূপ কোনো উক্তি নাই। রাজা শূরপাল সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে যে তিনি কেদারমিশ্রের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হইয়া অনেকবার শ্রদ্ধাবনতশিরে পবিত্র শান্তিবারি গ্রহণ করিয়াছিলেন।
ধর্ম্মপাল ও দেবপাল বাহুবলে যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন যজ্ঞের শান্তিবারি বা তপস্যা দ্বারা তাহা রক্ষা করা সম্ভবপর ছিল না। সুতরাং বিগ্রহপাল ও নারায়ণপালের অর্দ্ধশতাব্দীর অধিককালব্যাপী রাজ্যকালে বিশাল পালসাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হইয়া গেল, এমনকি বিহার ও বাংলা দেশের কোনো কোনো অংশও বহিঃশত্রু কর্ত্তৃক অধিকৃত হইল।