দেবপাল অন্তত ৩৫ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। তাঁহার রাজ্যকাল ৮১০ হইতে ৮৫০ অব্দ অনুমান করা যাইতে পারে। তাঁহার সময়ে পালসাম্রাজ্য গৌরবের চরম শিখরে আরোহণ করিয়াছিল। তাঁহার রাজত্বকালে বাঙ্গালী সৈন্য ব্রহ্মপুত্র হইতে সিন্ধু নদের তীরে এবং সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের প্রায় শেষ প্রান্ত পৰ্য্যন্ত বিজয়াভিযান করিয়াছিল। প্রায় সমগ্র আর্য্যাবর্ত্ত তাঁহাকে অধীশ্বর বলিয়া স্বীকার করিত। ভারতবর্ষের বাহিরেও তাঁহার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি হইয়াছিল। যবদ্বীপ, সুমাত্রা ও মলয় উপদ্বীপের অধিপতি শৈলেন্দ্রবংশীয় মহারাজ বালপুত্রদেব তাঁহার নিকট দূত প্রেরণ করেন। শৈলেন্দ্ররাজ প্রসিদ্ধ নালন্দাবিহারে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন এবং ইহার ব্যয় নির্বাহের জন্য পাঁচটি গ্রাম প্রার্থনা করেন। তদনুসারে দেবপাল তাঁহাকে পাঁচটি গ্রাম দান করেন। নালন্দা তখন সমগ্র এশিয়ার মধ্যে বৌদ্ধধর্ম্মের প্রধান কেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছিল এবং পালরাজগণও বৌদ্ধধর্ম্মের পৃষ্ঠপোষকরূপে ভারতের বাহিরে সর্বত্র বৌদ্ধগণের নিকট সুপরিচিত ও সম্মানিত ছিলেন। দেবপাল যে নালন্দাবিহারের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিলেন অন্য একখানি শিলালিপিতে তাঁহার কিছু আভাস আছে। ইহা হইতে আমরা জানিতে পারি যে নগরহার (বর্ত্তমান জালালাবাদ) নিবাসী ব্রাহ্মণবংশীয় ইন্দ্রগুপ্তের পুত্র বীরদেব “দেবপাল নামক ভুবনাধিপতির নিকট পূজাপ্রাপ্ত” এবং “নালন্দার পরিপালনভার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।”
৮৫১ অব্দে আরবী ভাষায় লিখিত একখানি গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, তৎকালে ভারতে তিনটি প্রধান রাজ্য ছিল। ইহাদের মধ্যে দুইটি যে রাষ্ট্রকূট ও গুর্জর প্রতীহার তাহা বেশ বুঝা যায়। তৃতীয়টি রুগি অথবা রহ্ম। এই নামের অর্থ বা উৎপত্তি যাহাই হউক ইহা যে পালরাজ্যকে সূচিত করে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। উল্লিখিত গ্রন্থ অনুসারে রক্ষ দেশের রাজা প্রতিবেশী গুর্জর ও রাষ্ট্রকূটরাজার সহিত সৰ্ব্বদাই যুদ্ধে লিপ্ত থাকিতেন। কিন্তু তাঁহার সৈন্য শত্রুসৈন্য অপেক্ষা সংখ্যায় অধিক ছিল। যুদ্ধ যাত্রাকালে ৫০,০০০ রণহস্তী এবং সৈন্যগণের বস্ত্রাদি ধৌত করিবার জন্যই দশ-পনেরো হাজার অনুচর তাঁহার সঙ্গে থাকিত। এই বর্ণনা সম্ভবত দেবপাল সম্বন্ধে প্রযোজ্য।
সোড্ঢল প্রণীত উদয়সুন্দরীকথা নামক কাব্য হইতে জানা যায় যে, অভিনন্দ পালরাজ যুবরাজের সভাপতি ছিলেন। অভিনন্দ প্রণীত রামচরিত কাব্যে যুবরাজের আরও কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ধর্ম্মপালের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং “পালকুলচন্দ্র” এবং “পালকুল প্রদীপ” প্রভৃতি আখ্যায় বিভূষিত হইয়াছেন। তাঁহার উপাধি ছিল হারবর্ষ এবং পিতার নাম বিক্রমশীল। তিনি অনেক রাজ্য জয় করিয়াছিলেন।
যুজরাজ হারবর্ষ যে পালবংশীয় রাজা ছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। বিক্রমশীল ও ধর্ম্মপালেরই নামান্তর তাহাতেও সন্দেহ করিবার বিশেষ কারণ নাই-কারণ তাঁহার প্রতিষ্ঠিত বিহার শ্রীমদ্-বিক্রমশীল-দেব-মহাবিহার নামে অভিহিত হইয়াছে। সুতরাং যুবরাজ হারবর্ষ ধর্ম্মপালের পুত্র ছিলেন এইরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু হারবর্ষ যুবরাজ দেবপালেরই নামান্তর অথবা তাঁহার ভ্রাতা এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না।
ধর্ম্মপাল ও দেবপালের রাজ্যকালে বাংলার শক্তি ও সমৃদ্ধি কিরূপ বাড়িয়াছিল তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তিব্বতদেশীয় গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে যে ধর্ম্মপাল তিব্বতের রাজা খ্রী স্রং-দে-বৎ সনের (৭৫৫-৭৯৭ অব্দ) বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তিব্বতীয় রাজা র-প-চন্ (৮১৭-৮৩৬) গঙ্গাসাগর পর্য্যন্ত জয় করেন। এই প্রকার দাবীর মূলে কত দূর সত্য নিহিত আছে তাহা জানিবার উপায় নাই কারণ ভারতীয় কোনো গ্রন্থ বা লিপিতে উক্ত তিব্বতীয় অভিযানের কোনো উল্লেখ নাই। তবে এরূপ অভিযান অসম্ভব নহে এবং সম্ভবত মাঝে মাঝে ইহার ফলে পালরাজগণ বিপন্ন হইতেন। নাগভট কর্ত্তৃক ধর্ম্মপালের পরাজয় এবং প্রথম ভোজের ৮৩৬ অব্দে কনৌজ অধিকার প্রভৃতি ঘটনার সহিত এরূপ কোনো তিব্বতীয় অভিযানের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সম্বন্ধ থাকা বিচিত্র নহে।
অর্দ্ধশতাব্দীর অধিককাল পর্য্যন্ত ধর্ম্মপাল ও দেবপাল আর্য্যাবর্তে বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন। অনেকে মনে করেন যে হর্ষবর্দ্ধনের সাম্রাজ্যই আর্য্যাবর্তের শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য কিন্তু পালসাম্রাজ্য যে ইহার অপেক্ষা বিস্তৃত ও অধিককাল স্থায়ী হইয়াছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
প্রাচীন মৌৰ্য্য ও গুপ্তসাম্রাজ্যের সহিত পালসাম্রাজ্যের প্রকৃতিগত প্রভেদ ছিল। মৌর্য ও গুপ্তসাম্রাজ্যের বিস্তৃত ভূভাগ স্বয়ং সম্রাট অথবা তন্নিযুক্ত শাসনকর্ত্তার অধীনে থাকিত। কিন্তু বাংলা ও বিহার ব্যতীত আৰ্য্যাবর্তের অপর কোনো প্রদেশ যে পালরাজগণের বা তাহাদের কর্ম্মচারীর শাসনাধীন ছিল এরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। পরাজিত রাজগণ পালরাজগণের অধীনতা ও কোনো কোনো স্থলে করদান করিতে স্বীকার করিলেই সম্ভবত তাঁহারা বিনা বাধায় স্বীয় রাজ্য শাসন করিতে পারিতেন। তাঁহারা পালরাজগণকে উপঢৌকন পাঠাইতেন, মাঝে মাঝে তাঁহাদের সভায় উপস্থিত থাকিতেন এবং সম্ভবত প্রয়োজন হইলে সৈন্য দিয়া সাহায্য করিতেন। কিন্তু ইহার অতিরিক্ত আর কোনো প্রকার দায়িত্ব সম্ভবত তাঁহাদের ছিল না। এ সম্বন্ধে এ পর্য্যন্ত যে প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে তাহা এতই স্বল্প যে নিশ্চিত কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত করা কঠিন; তবে হর্ষবর্দ্ধনের সাম্রাজ্য যে এ বিষয়ে পালসাম্রাজ্যের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিল এবং সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ধর্ম্মপাল বা দেবপাল অপেক্ষা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তাঁহার অধিকতর শক্তি বা ক্ষমতা ছিল এরূপ মনে করিবার কোনোই কারণ নাই।