উল্লিখিত লিপি দুইখানির মতে দেবপালের রাজত্বের যত কিছু গৌরব ও কৃতিত্ব তাহা কেবল মন্ত্রীদ্বয় ও সেনাপতিরই প্রাপ্য। গুরবমিশ্রের লিপিতে ইহাও বলা হইয়াছে যে অগণিত রাজন্যবর্গের প্রভু সম্রাট দেবপাল (উপদেশ গ্রহণের জন্য স্বয়ং) দৰ্ভপাণির অবসরের অপেক্ষায় তাঁহার দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া থাকিতেন এবং রাজসভার আগে এই মন্ত্রীবরকে মূল্যবান আসন দিয়া নিজে ভয়ে ভয়ে সিংহাসনে বসিতেন।
যখন এই সমুদয় উক্তি লিখিত হয় তখন পালবংশের বড়ই দুর্দিন। সুতরাং তখনকার হতমান দুৰ্বলচিত্ত পালরাজের পক্ষে এই প্রকার আচরণ সম্ভবপর হইলেও ধর্ম্মপালের পুত্র আর্য্যাবর্তের অধীশ্বর দেবপালদেবের সম্বন্ধে ইহা বিশ্বাস করা কঠিন। এই সমুদয় অত্যুক্তির মধ্যে কী পরিমাণ সত্য নিহিত আছে তাঁহার অনুসন্ধান নিষ্প্রয়োজন। কারণ দেবপালের রাজ্যকাল বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তারই ইতিহাসের মুখ্য ঘটনা, তাহা কী পরিমাণে সেনাপতির বাহুবলে অথবা মন্ত্রীর বুদ্ধিকৌশলে হইয়াছিল এই বিচার অপেক্ষাকৃত গৌণ বিষয়।
উপরে বিজিত রাজগণের যে বিবরণ দেওয়া হইয়াছে তাহা হইতে সহজেই বুঝা যায় যে, দেবপাল উড়িষ্যা ও আসাম বাংলার এই দুই সীমান্ত প্রদেশ জয় করেন। আসামের রাজা বিনাযুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করিয়া সামন্ত রাজার ন্যায় রাজত্ব করিতেন। কিন্তু উড়িষ্যার রাজাকে দূরীভূত করিয়া উড়িষ্যা সম্ভবত পালরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছিল। উকলাধীশের রাজধানী পরিত্যাগ এবং ‘উকীলিতোকলকুল’ এই প্রকার পদপ্রয়োগ এই সিদ্ধান্তের সমর্থন করে। উড়িষ্যার ভঞ্জ রাজবংশের লিপি হইতে জানা যায় যে, রণভঞ্জের পর এই বংশীয় রাজগণ প্রাচীন খিঞ্জলী রাজ্য ও রাজধানী ত্যাগ করিয়া উড়িষ্যার দক্ষিণ সীমান্তে গঞ্জাম জিলায় আশ্রয় লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। রণভঞ্জ সম্ভবত নবম শতাব্দের প্রথম ভাগ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন। সুতরাং খুব সম্ভব যে এই বংশীয় রাজাকে দূর করিয়াই দেবপাল উড়িষ্যা, অন্তত তাঁহার অধিকাংশ ভাগ, অধিকার করেন।
দেবপাল যে হৃণজাতির গৰ্ব্ব খৰ্ব্ব করেন তাহাদের রাজ্য কোথায় ছিল তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভে হূণজাতি আৰ্য্যাবৰ্ত্তের পশ্চিম ভাগে বিস্তৃত রাজ্য স্থাপন করিয়াছিল। কিন্তু তাহারা ক্রমশ হীনবল হইয়া পড়ে এবং বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করে। হর্ষচরিত পাঠে জানা যায় যে, উত্তরাপথে হিমালয়ে নিকটে হূণদের একটি রাজ্য ছিল। সম্ভবত দেবপাল এই রাজ্য জয় করিয়া কাম্বোজ পৰ্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন। কাম্বোজ পঞ্চনদের উত্তর পশ্চিমে ও গন্ধারের ঠিক উত্তরে এবং হূণরাজ্যের ন্যায় পালসাম্রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত ছিল। সুতরাং এই দুই রাজ্যের সহিত দেবপালের বিরোধ খুবই স্বাভাবিক। এখানে বলা আবশ্যক যে মালব প্রদেশেও একটি হূণরাজ্য ছিল।
দেবপাল যে গুজ্জর রাজার দর্প চূর্ণ করিয়াছিলেন তিনি সম্ভবত নাগভট্টের পৌত্র প্রথম ভোজ। রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের হস্তে নিদারুণ পরাজয়ের পর প্রতীহাররাজ নাগভট ও তাঁহার পুত্র রামভদ্রের শক্তি অতিশয় ক্ষীণ হইয়াছিল। রামভদ্রের রাজ্যকালে প্রতীহার রাজ্য শত্রু কর্ত্তৃক বিধ্বস্ত হইয়াছিল এরূপ ইঙ্গিতও এই বংশের লিপিতে পাওয়া যায়। তৎপুত্র ভোজ প্রথমে কিছু সফলতা লাভ করিয়াছিলেন, কারণ তিনি ৮৩৬ অব্দে কনৌজ ও কালঞ্জরের আধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি ৮৬৭ অব্দের পূর্ব্বে রাষ্ট্রকূটরাজ কর্ত্তৃক পরাজিত এবং ৮৬৯ অব্দের পূর্ব্বে স্বীয় রাজ্য গুজ্জরা (বর্ত্তমান রাজপুতনা) হইতে বিতাড়িত হন। সম্ভবত ৮৪০ হইতে ৮৬০ অব্দের মধ্যে দেবপাল তাঁহাকে পরাজিত করেন।
এইরূপে দেখিতে পাই যে, ধর্ম্মপাল যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন দেবপাল তাঁহার সীমান্তস্থিত কামরূপ, উল্কল, হূণদেশ ও কামোজ জয় করেন এবং চিরশত্রু প্রতীহাররাজকে পরাজিত করেন। সুতরাং প্রশস্তিকার যে তাঁহার রাজ্য হিমালয় হইতে বিন্ধ্যপর্বত এবং পূর্ব্ব হইতে পশ্চিম সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন তাহা মোটামুটিভাবে সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায়।
মুঙ্গেরে প্রাপ্ত দেবপালের তাম্রশাসনে তাঁহার সাম্রাজ্য হিমালয় হইতে রামেশ্বর সেতুবন্ধ পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। ইহা অতিরঞ্জিত এবং নিছক কবিকল্পনা বলিয়াই সকলে গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু ইহার মূলে কিছু সত্য থাকিতে পারে। দেবপাল যে দ্রবিড়নাথের দর্প চূর্ণ করিয়াছিলেন ঐতিহাসিকেরা তাঁহাকে দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটরাজ বলিয়াই গ্রহ করিয়াছেন। প্রতীহার রাজার ন্যায় রাষ্ট্রকূট রাজার সহিতও পালরাজগণের বংশানুক্রমিক শত্রুতা ছিল, সুতরাং দেবপাল কোনো রাষ্ট্রকূটরাজাকে পরাভূত করিয়া থাকিবেন ইহা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দ্রবিড় বলিতে সাধারণত দাক্ষিণাত্য বুঝায় না, ইহা দক্ষিণ ভারত অর্থাৎ কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণস্থিত ভূভাগের নাম। এই সুদূর দেশে যে দেবপাল যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিলেন ইহার সপক্ষে কোনো প্রমাণ না থাকাতেই পণ্ডিতগণ তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী দ্রবিড়নাথ ও রাষ্ট্রকূটরাজকে অভিন্ন বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের কয়েকখানি লিপি হইতে জানা যায় যে, মগধ, কলিঙ্গ, চোল, পল্লব ও গঙ্গ প্রভৃতি রাজ্য মিলিত হইয়া পাণ্ড্যরাজের সহিত যুদ্ধ করে। কুম্বকোন নামক স্থানে পাণ্ড্যরাজ শ্রীমার শ্রীবল্লভ ইহাদের পরাস্ত করেন। শ্রীমার শ্রীবল্লভের রাজ্যকাল ৮৫১ হইতে ৮৬২ অব্দ। ইহার অব্যবহিত পূর্ব্বে দেবপাল যে মগধের রাজা ছিলেন সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই; এবং উত্তাল জয় করার পর যে তিনি কলিঙ্গ প্রভৃতি দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হইয়া থাকিবেন ইহাও খুব স্বাভাবিক। সুতরাং অসম্ভব নহে যে উল্লিখিত মিলিত শক্তির সহিত দেবপাল পাণ্ড্যরাজ্যে অবস্থিত। সুতরাং দেবপালের সভাপতি হয়তো এই সমরবিজয় উপলক্ষ করিয়া দেবপালের রাজ্য রামেশ্বর সেতুবন্ধ পর্য্যন্ত বিস্তৃত বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।