ধর্ম্মপাল রাষ্ট্রকূটরাজ পরবলের কন্যা রন্নাদেবীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। এই পরবল কে এবং কোথায় রাজত্ব করিতেন, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছুই বলা যায় না। ৮৬১ অব্দে উত্তীর্ণ রাষ্ট্রকূটবংশীয় পরবল নামক রাজার একখানি শিলালিপি মধ্যভারতে পাওয়া গিয়াছে। কেহ কেহ মনে করেন যে ইনিই রন্নাদেবীর পিতা। কিন্তু ঐ তারিখের অর্দ্ধশতাব্দী পূর্ব্বেই দীর্ঘকাল রাজত্বের পর ধর্ম্মপালের মৃত্যু হয়। সুতরাং একেবারে সম্ভব না হইলেও ধর্ম্মপালের সহিত উক্ত পরবলের কন্যার বিবাহ খুব অস্বাভাবিক ঘটনা বলিয়াই গ্রহণ করিতে হইবে। রন্নাদেবী দাক্ষিণাত্যের প্রসিদ্ধ রাষ্ট্রকূটবংশের কোনো রাজকন্যা ছিলেন এই মতটিই অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে হয়।
ধর্ম্মপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বাপাল অনেক যুদ্ধে তাঁহার সেনাপতি ছিলেন এবং গর্গ নামে এক ব্রাহ্মণ তাঁহার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বাপাল ও গর্গের বংশধরগণের লিপিতে এই দুইজনের কৃতিত্ব বিশদভাবে বর্ণিত হইয়াছে এবং প্রধানত তাঁহাদের সাহায্যেই যে ধর্ম্মপালসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সফলকাম হইয়াছিলেন এরূপ স্পষ্ট ইঙ্গিতও আছে। এই উক্তির মধ্যে কিছু সত্য থাকিলেও ইহা যে অতিরঞ্জন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
পিতার ন্যায় ধর্ম্মপালও বৌদ্ধ ছিলেন। তিব্বতদেশীয় গ্রন্থে ধর্ম্মপালের অনেক কীর্তিকলাপের উল্লেখ আছে। মগদে তিনি একটি বিহার বা বৌদ্ধমঠ নির্মাণ করেন। তাঁহার বিক্রমশীল এই দ্বিতীয় নাম বা উপাধি অনুসারে ইহা ‘বিক্রমশীলবিহার’ নামে অভিহিত হয়। নালন্দার ন্যায় বিক্রমশীল বিহারও ভারতের সৰ্ব্বত্র ও ভারতের বাহিরে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। গঙ্গাতটে এক শৈলশিখরে অবস্থিত এই বিহারে একটি প্রধান মন্দির এবং তাঁহার চারিদিকে ১০৭টি ছোট মন্দির ছিল। এটি একটি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল এবং ১১৪ জন শিক্ষক এখানে নানা বিষয় অধ্যাপনা করিতেন। তিব্বতের বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু এখানে অধ্যয়ন করিতে আসিতেন এবং এখানকার অনেক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচাৰ্য্য তিব্বতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচার করিয়াছেন। বরেন্দ্র ভূমিতে সোমপুর নামক স্থানে ধৰ্ম্মপাল আর একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। রাজসাহী জিলার অন্তর্গত পাহাড়পুর নামক স্থানে ইহার বিরাট ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। এত বড় বৌদ্ধবিহার ভারতবর্ষের আর কোথাও ছিল বলিয়া জানা যায় নাই। যে সুবিস্তৃত অঙ্গনের চতুর্দিক ঘিরিয়া এই বিহারটি ছিল, তাঁহার মধ্যস্থলে এক বিশাল মন্দিরের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়াছে। এই প্রকার গঠনরীতি ভারতবর্ষের আর কোনো মন্দিরে দেখা যায় না। শিল্প-শীর্ষক অধ্যায়ে এই মন্দির ও বিহারের বর্ণনা করা যাইবে। পাহাড়পুরের নিকটবর্ত্তী ওমপুর গ্রাম এখনো প্রাচীন সোমপুরের স্মৃতি রক্ষা করিয়া আসিতেছে। ওদন্ত পুরেও (বিহার) ধর্ম্মপাল সম্ভবত একটি বিহার নির্মাণ করিয়াছিলেন। তিব্বতীয় লেখক তারনাথের মতে ধৰ্ম্মপাল ধৰ্ম্মশিক্ষার জন্য ৫০টি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।
ধর্ম্মপাল নিজে বৌদ্ধ হইলেও হিন্দুধর্ম্মের প্রতি তাঁহার কোনো বিদ্বেষ ছিল না। নারায়ণের এক মন্দিরের জন্য তিনি নিষ্কর ভূমি দান করিয়াছিলেন। তিনি শাস্ত্রানুশাসন মানিয়া চলিতেন এবং প্রতি বর্ণের লোক যাহাতে স্বধর্ম্ম প্রতিপালন করে তাঁহার ব্যবস্থা করিতেন। তাঁহার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ এবং ইঁহার বংশধররা বহুপুরুষ পৰ্য্যন্ত বৌদ্ধ পালরাজগণের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেকালে যে রাজার ব্যক্তিগত ধর্ম্মবিশ্বাসের সহিত রাজ্যশাসন ব্যাপারের কোনো সম্বন্ধ ছিল না এই দৃষ্টান্ত হইতে তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে।
খালিমপুর তাম্রশাসন ধৰ্ম্মপালের বিজয়রাজ্যের ৩২ সম্বৎসরে লিখিত। ইহার পর ধর্ম্মপাল আর কত বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন, তাহা নিশ্চিত জানা যায় না। তারনাথের মতে ধর্ম্মপালের রাজ্যকাল ৬৪ বৎসর-কিন্তু ইহার সমর্থক কোনো প্রমাণ নাই।
ধর্ম্মপালের মৃত্যুর পর রন্নাদেবীর গর্ভজাত তাঁহার পুত্র দেবপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। ধর্ম্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনে কিন্তু যুবরাজ ত্রিভুবন পালের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই যুবরাজ ত্রিভুবনপালই দেবপাল নামে রাজা হন অথবা জ্যেষ্ঠভ্রাতা ত্রিভুবনপালের মৃত্যুতে কনিষ্ঠ দেবপাল পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। এই শেষোক্ত অনুমানই সত্য বলিয়া মনে হয়। কারণ খালিমপুর তাম্রশাসনে রাজপুত্র দেবটেরও উল্লেখ আছে এবং অসম্ভব নহে যে ইহা দেবপাল নামের অপভ্রংশ। অবশ্য ত্রিভুবনপাল জীবিত থাকিলেও কনিষ্ঠ দেবপাল সিংহাসন অধিকার করিয়া থাকিতে পারেন। কিন্তু এ সকলই অনুমান মাত্র।
.
৩. দেবপাল (আ ৮১০-৮৫০)
পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ দেবপাল পিতার উপযুক্ত পুত্র ছিলেন এবং পিতৃসাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি অনেক যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিলেন এবং নূতন নূতন রাজ্য জয় করিয়াছিলেন। তাঁহার তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে তাঁহার বিজয়বাহিনী দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত ও পশ্চিমে কাম্বোজ দেশ অর্থাৎ কাশ্মীরের সীমান্ত পৰ্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিল। তাঁহার সেনাপতি ও মন্ত্রীগণের বংশধরদের লিপিতে বিজিত রাজ্যের তালিকা পাওয়া যায়। পিতৃব্য বাকপালের পুত্র জয়পাল তাঁহার সেনাপতি ছিলেন। জয়পালের বংশধর নারায়ণপালের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে জয়পাল দিগ্বিজয়ে অগ্রসর হইলে উল্কলের রাজা দূর হইতে তাঁহার নামমাত্র শ্রবণ করিয়াই অবসন্ন হইয়া নিজের রাজধানী পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। প্রাগজ্যোতিষের (আসাম) রাজা জয়পালের আজ্ঞায় যুদ্ধোদ্যম ত্যাগ করিয়া পালরাজের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন। ধর্ম্মপালের মন্ত্রী গর্গের পুত্র দর্ভপাণি এবং প্রপৌত্র কেদারমিশ্র উভয়েই দেবপালের রাজ্যকালে প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। কেদারমিশ্রের পুত্র গুরবমিশ্রের লিপিতে উক্ত হইয়াছে যে দর্ভপাণির নীতিকৌশলে দেবপাল হিমালয় হইতে বিন্ধ্যপর্বত এবং পূর্ব্ব ও পশ্চিম সমুদ্রের মধ্যবর্ত্তী সমগ্র ভূভাগ করপ্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এই লিপিতে আরও উক্ত হইয়াছে যে মন্ত্রী কেদারমিশ্রের বুদ্ধিবলের উপাসনা করিয়া গৌড়েশ্বর দেবপালদেব উৎকলকুল ধ্বংস, হূণগৰ্ব খৰ্ব্ব এবং দ্রবিড় ও গুজ্জরনাথের দর্প চূর্ণ করিয়া দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত আসমুদ্র পৃথিবী উপভোগ করিয়াছিলেন।