এই বিশাল সাম্রাজ্যের মধ্যে মাত্র বাংলা দেশ ও বিহার ধর্ম্মপালের নিজ শাসনাধীনে ছিল। অন্যান্য পরাজিত রাজগণ ধর্ম্মপালের প্রভুত্ব স্বীকার করিয়া স্বীয় স্বীয় রাজ্য শাসন করিতেন। কেবলমাত্র কান্যকুজে পরাজিত ইন্দ্ররাজের পরিবর্তে ধর্ম্মপাল চক্ৰায়ুধ নামক একজন নূতন ব্যক্তিকে রাজপদে অভিষিক্ত করিয়াছিলেন।
ধর্ম্মপাল নিরুদ্বেগে এই বিশাল সাম্রাজ্য ভোগ করিতে পারেন নাই। তাঁহার পূর্ধ্বতন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতীহাররাজ বৎসরাজের পুত্র নাগভট শীঘ্রই কতক রাজ্য জয় এবং কতক রাজ্যের সহিত মিত্ৰতা স্থাপনপূৰ্ব্বক স্বীয় শক্তি বৃদ্ধি করিয়া ধৰ্ম্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। তিনি প্রথমে চক্ৰায়ুধকে পরাজিত করেন, এবং চক্ৰায়ুধ ধৰ্ম্মপালের শরণাপন্ন হন। অবশেষে ধৰ্ম্মপালের সহিত নাগভটের বিষম যুদ্ধ হয়। প্রতীহাররাজের প্রশস্তি অনুসারে নাগভট এই যুদ্ধে জয়ী হন। কিন্তু অচিরকাল মধ্যেই রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ নাটভটের রাজ্য আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করেন এবং বৎসরাজের ন্যায় নাগভট্টের সাম্রাজ্য স্থাপনের আশাও দূরীভূত হয়।
রাষ্ট্রকূটরাজগণের প্রশস্তি অনুসারে ধর্ম্মপাল ও চক্ৰায়ুধ উভয়ে স্বেচ্ছায় তৃতীয় গোবিন্দের আনুগত্য স্বীকার করেন। ইহা হইতে এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না যে ধৰ্ম্মপাল ও চক্ৰায়ুধ নাগভটকে দমন করিবার নিমিত্তই রাষ্ট্রকূটরাজের শরণাপন্ন হইয়াছিলেন এবং তাঁহাদের আমন্ত্রণেই তৃতীয় গোবিন্দ নাটভাটের রাজ্য ধ্বংস করিয়াছিলেন। সে যাহাই হইক, পিতার ন্যায় তৃতীয় গোবিন্দও শীঘ্রই দক্ষিণাপথে রহিল না। নাগভট্টের পরাজয় এরূপ গুরুতর হইয়াছিল যে, তিনি এবং তাঁহার পুত্র আর পালরাজগণের বিরুদ্ধে কিছুই করিতে পারিলেন না। সুতরাং ধর্ম্মপালের বিশাল সাম্রাজ্য অটুট রহিল এবং সম্ভবত শেষ বয়সে তিনি শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলেন।
ধর্ম্মপালের বাহুবলে বাংলা দেশে যেরূপ গুরুতর রাজনৈতিক পরিবর্ত্তন হইয়াছিল সচরাচর তাঁহার দৃষ্টান্ত মিলে না। অর্দ্ধশতাব্দী পূর্ব্বে যে দেশ পরপদানত এবং অরাজকতা ও অত্যাচারের লীলাভূমি ছিল সেই দেশ সহসা প্রচণ্ড শক্তিশালী হইয়া সমগ্র আর্য্যাবর্তে নিজের প্রভুত্ব বিস্তার করিবে ইহা অলৌকিক কাহিনীর মতোই অদ্ভুত মনে হয়। এই সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই বাঙ্গালীর নূতন জাতীয় জীবনের সূত্রপাত হয়। ধৰ্ম্ম শিল্প ও সাহিত্যের অভ্যুদয়েই এই জাতীয় জীবন প্রধানত আত্মবিকাশ করিয়াছিল। পালরাজগণের চারিশত বর্ষব্যাপী রাজ্যকাল বাঙ্গালী জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ। ধর্ম্মপালের রাজ্য বাঙ্গালীর জীবন প্রভাত।
এই নূতন যুগের বাঙ্গালীর আশা-আকাক্ষা কল্পনা ও আদর্শ সমসাময়িক রচনার মধ্য দিয়া কিয়ৎ পরিমাণে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে। খালিমপুর তাম্রশাসনে ধর্ম্মপালের ‘পাটলিপুত্ৰনগর-সমাবাসিত-শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবারের’ যে বর্ণনা আছে, তাহাতে নবসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার গর্বে দৃপ্ত বাঙ্গালীর মানচিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছে। অশোকের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত মৌৰ্য্য রাজগণের প্রাচীন রাজধানী পাটলিপুত্রে (বর্ত্তমান পাটনা) ধর্ম্মপাল সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে রাজধানী স্থাপন করিয়াছিলেন। কবি তাঁহার বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন যে এখানে গঙ্গাবক্ষে অসংখ্য বিশাল রণতরীর সমাবেশ সেতুবন্ধ রামেশ্বরের শৈলশিখরশ্রেণী বলিয়া মনে হইত; এখানকার অসংখ্য রণহস্তী দিনশোভাকে স্নান করিয়া নিবিড় মেঘের শোভা সৃষ্টি করিত; উত্তরাপথের বহু সামন্তরাজগণ যে অগণিত অশ্ব উপঢৌকনস্বরূপ পাঠাইয়াছিলেন তাহাদের ক্ষুরোখিত ধূলিজালে এই স্থান চতুর্দিক ধূসরিত হইয়া থাকিত; এবং রাজরাজেশ্বর ধর্ম্মপালের সেবার জন্য সমস্ত জম্বুদ্বীপ (ভারতবর্ষ) হইতে যে সমস্ত রাজগণ এখানে উপস্থিত হইয়াছিলেন তাঁহাদের অনন্ত পদাতিসেনার পদভারে বসুন্ধরা অবনত হইয়া থাকিত। শক্তি, সম্পদ ও ঐশ্বর্য্যের এই বর্ণনার মধ্যে যে আতিশয্য আছে তাহা বাঙ্গালীর তল্কালীন জাতীয় মনোভাবের পরিচায়ক।
এই নূতন জাতীয় জীবনের সৃষ্টিকর্ত্তা ধর্ম্মপালকে বাঙ্গালী কী চক্ষে দেখিত তাহা অনায়াসেই আমরা কল্পনা করিতে পারি। কবি একটিমাত্র শ্লোকে তাঁহার একটু আভাস দিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন যে সীমান্তদেশে গোপগণ, বনে বনচরগণ, গ্রামসমীপে জনসাধারণ, প্রত্যেক গৃহপ্রাঙ্গণে ক্রীড়ারত শিশুগণ, প্রতি দোকানে ক্রয়বিক্রয়কারীগণ, এমনকি বিলাসগৃহের পিঞ্জরস্থিত শুকগণও সৰ্ব্বদা ধর্ম্মপালের গুণগান করিত; সুতরাং ধর্ম্মপাল সৰ্ব্বত্র এই আত্মম্ভতি শ্রবণ করিতেন এবং লজ্জায় সৰ্ব্বদাই তাঁহার বদনমণ্ডল নত হইয়া থাকিত।
একদিন বাংলার মাঠে-ঘাটে ঘরে-বাহিরে যাহার নাম লোকের মুখে মুখে ফিরিত, তাঁহার কোনো স্মৃতিই আজ বাংলা দেশে নাই। অদৃষ্টের নিদারুণ পরিহাসে বাঙ্গালী তাঁহার নাম পৰ্য্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিল। কয়েকখানি তাম্রশাসন ও শিলালিপি এবং তিব্বতীয় গ্রন্থের সাহায্যে আমরা তাঁহার কীর্তিকলাপের ক্ষীণ প্রতিধ্বনিমাত্র পাইয়াছি, কিন্তু তাঁহার জীবনীর বিশেষ কোনো বিবরণ জানিতে পারি নাই। বাঙ্গালীর দুর্ভাগ্য, বাংলা দেশের দুর্ভাগ্য যে কয়েকটি স্কুল ঘটনা ব্যতীত এই মহাবীর ও মহাপুরুষের ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্র সম্বন্ধে আর কিছুই জানিবার উপায় নাই।