ধ্রুব বৎসরাজকে পরাস্ত করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন না। তিনি ধর্ম্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইলেন। ধর্ম্মপাল ইতিমধ্যে মগধ, বারাণসী, ও প্রয়াগ জয় করিয়া গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্ত্তী ভূভাগ পর্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছিলেন। এইখানেই ধ্রুবের সহিত তাঁহার যুদ্ধ হইল। রাষ্ট্রকূটরাজের প্রশস্তিমতে ধ্রুব ধৰ্ম্মপালকে পরাজিত করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহাতে ধর্ম্মপালের বিশেষ কোনো অনিষ্ট হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। ধ্রুব শীঘ্রই দক্ষিণাপথে ফিরিয়া গেলেন। এবং ধর্ম্মপালের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রহিল না। এই সুযোগে ধর্ম্মপাল ক্রমে ক্রমে প্রায় সমগ্ৰ আৰ্য্যাবর্ত্ত জয় করিয়া নিজের আধিপত্য স্থাপন করিলেন। ইহার ফলে তিনি সার্বভৌম সম্রাটের পদ প্রাপ্ত হইলেন এবং গৌরবসূচক ‘পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’ প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করিলেন।
ধর্ম্মপালের পুত্র দেবপালের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে ধৰ্ম্মপাল দিগ্বিজয়ে প্রবৃত্ত হইয়া কেদার ও গোকর্ণ এই দুই তীর্থ এবং গঙ্গাসাগর সঙ্গম দর্শন করিয়াছিলেন। কেদার হিমালয়ে অবস্থিত সুপরিচিত তীর্থ। গোকর্ণের অবস্থিতি লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কাহারও মতে ইহা বোম্বে প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত উত্তর কাণাড়ায় অবস্থিত সুপরিচিত গোকর্ণ নামক তীর্থ। কিন্তু ধর্ম্মপাল যে দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটরাজ্য পার হইয়া এই দূরদেশে বিজয়াভিযান করিয়াছিলেন বিশিষ্ট প্রমাণ অভাবে তাহা বিশ্বাস করা কঠিন। নেপালে বাগমতী নদীর তীরে পশুপতি মন্দিরের দুই মাইল উত্তর-পূর্ব্বে গোকর্ণ নামে তীর্থ আছে–সম্ভবত ধর্ম্মপাল এই স্থানে গমন করিয়াছিলেন। এই অনুমানের সপক্ষে বলা যাইতে পারে যে স্বয়ম্ভুপুরাণে উক্ত হইয়াছে যে গৌড়রাজ ধর্ম্মপাল নেপালের সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। গোকর্ণ যেখানেই অবস্থিত হউক, ধৰ্ম্মপালের সেনাবাহিনী দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়া যে পাঞ্জাবের প্রান্ত পর্য্যন্ত বিজয়াভিযান করিয়াছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
আর্য্যাবর্তে আধিপত্য লাভ করিবার জন্য ধর্ম্মপালকে বহু যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল। কিন্তু উক্ত দিগ্বিজয়ের উল্লেখ ব্যতীত পালরাজগণের প্রশস্তিতে এই সমুদয় যুদ্ধের বিশদ কোনো বিবরণ নাই। এই দিগ্বিজয়ের প্রারম্ভেই তিনি ইন্দ্ররাজ প্রভৃতিকে জয় করিয়া মহোদয় অর্থাৎ কান্যকুব্জ অধিকার করিয়াছিলেন। প্রাচীন পাটলিপুত্র ও বর্ত্তমান দিল্লীর ন্যায় তৎকালে কান্যকুব্জই আৰ্য্যাবর্তের রাজধানী বলিয়া বিবেচিত হইত, এবং সাম্রাজ্য স্থাপনে অভিলাষী রাজগণ কান্যকুজের দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেন। ধর্ম্মপাল কান্যকুব্জ অধিকার করিয়া ক্রমে সিন্ধু নদ ও পাঞ্জাবের উত্তরে হিমালয়ের পাদভূমি পৰ্য্যন্ত জয় করিলেন। দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করিয়াও তিনি সম্ভবত কিছুদূর অগ্রসর হইয়াছিলেন। এইরূপে আর্য্যাবর্তের সার্বভৌমত্ব লাভ করিয়া ইহা প্রকাশ্যে ঘোষণা করিবার জন্য তিনি কান্যকুজে এক বৃহৎ রাজাভিষেকের আয়োজন করিলেন। এই রাজদরবারে আর্য্যাবর্তের বহু সামন্ত নরপতিগণ উপস্থিত হইয়া ধর্ম্মপালের অধিরাজত্ব স্বীকার করিলেন। মালদহের নিকটবর্ত্তী খালিমপুরে প্রাপ্ত ধৰ্ম্মপালের তাম্রশাসনে এই ঘটনাটি নিম্নলিখিতরূপে বর্ণিত হইয়াছে। “তিনি মনোহর ভঙ্গি-বিকাশে ইঙ্গিত মাত্রে] ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গন্ধার এবং কীর প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদের [সামন্ত?] নরপালগণকে প্রণতিপরায়ণ চঞ্চলাবনত মস্তকে সাধু সাধু বলিয়া কীৰ্ত্তন করাইতে করাইতে হৃদচিত্ত পাঞ্চালবৃদ্ধকর্ত্তৃক মস্তকোপরি আত্মাভিষেকের স্বর্ণকলস উদ্ধৃত করাইয়া কান্যকুব্জকে রাজশ্রী প্রদান করিয়াছিলন।”
এই শ্লোকে যে সকল রাজ্যের উল্লেখ আছে, তাহাদের রাজগণ সকলেই কান্যকুজে আসিয়াছিলেন এবং যখন পঞ্চাল দেশের বয়োবৃদ্ধগণ ধর্ম্মপালের মস্ত কে স্বর্ণকলস হইতে পবিত্র তীর্থজল ঢালিয়া তাঁহাকে কান্যকুজের রাজপদে অভিষেক করিতেছিলেন তখন নতশিরে ‘সাধু সাধু’ বলিয়া এই কাৰ্য্য অনুমোদন করিয়াছিলেন-অর্থাৎ তাঁহাকে রাজচক্রবর্ত্তী বলিয়া সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিয়াছিলেন। সুতরাং অন্তত ঐ সমুদয় রাজ্যই যে ধৰ্ম্মপালের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল তাহা স্বীকার করিতেই হইবে। ইহার মধ্যে গন্ধার, মদ্র, কুরু ও কীর দেশ যথাক্রমে পঞ্চনদের পশ্চিম, মধ্য, পূর্ব্ব ও উত্তর ভাগে অবস্থিত। যবন দেশ সম্ভবত সিন্ধু নদের তীরবর্ত্তী কোনো মুসলমান অধিকৃত রাজ্য সূচিত করিতেছে। অবন্তি মালবের এবং মৎস্যদেশ আলওয়ার ও জয়পুর রাজ্যের প্রাচীন নাম। ভোজ ও যদু একাধিক রাজ্যের নাম ছিল। সুতরাং ইহা দ্বারা ঠিক কোন কোন দেশ সূচিত হইয়াছে, তাহা বলা কঠিন। সম্ভবত ভোজরাজ্য বর্ত্তমান বেরারে এবং যদুরাজ্য পাঞ্জাবে অথবা সুরাষ্ট্রে অবস্থিত ছিল।
এই সমুদয় রাজ্যের অবস্থিতি আলোচনা করিলে সহজেই অনুমিত হইবে যে ধর্ম্মপাল প্রায় সমগ্র আর্য্যাবর্তের অধীশ্বর ছিলেন। পালরাজগণের প্রশস্তি ব্যতীত অন্যত্রও ধর্ম্মপালের এই সাৰ্বভৌমত্বের উল্লেখ আছে। একাদশ শতাব্দীতে রচিত সোড়ল প্রণীত উদয়সুন্দরীকথা নামক চম্পু-কাব্যে ধর্ম্মপাল উত্তরাপথস্বামী বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন।