বাণভট্ট বলেন যে রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যার সংবাদ শুনিয়া হর্ষবর্দ্ধন শপথ করিলেন যে যদি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে তিনি পৃথিবী গৌড়শূন্য করিতে না পারেন, তবে অগ্নিতে ঝাঁপ দিয়া প্রাণত্যাগ করিবেন। অতঃপর গৌড়রাজের বিরুদ্ধে বিপুল সমর-সজ্জা হইল। হর্ষ সসৈন্যে অগ্রসর হইয়া পথিমধ্যে শুনিলেন যে তাঁহার ভগ্নী রাজ্যশ্রী কারাগার হইতে পলাইয়া বিন্ধ্যপর্বতে প্রস্থান করিয়াছেন। সুতরাং সেনাপতি ভণ্ডীকে সসৈন্যে অগ্রসর হইতে আদেশ দিয়া তিনি নিজে ভগ্নীর সন্ধানে বিন্ধ্যপর্বতে গমন করিলেন। সেখানে রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করিয়া তিনি গঙ্গাতীরে স্বীয় সৈন্যের সহিত মিলিত হইলেন।
বাণভট্টের গ্রন্থ এখানেই শেষ হইয়াছে। শশাঙ্কের সহিত হর্ষের যুদ্ধের কথা বাণভট্ট কিছুই বলেন নাই। কিন্তু হুয়েন সাং লিখিয়াছেন যে হর্ষ ছয় বৎসর যাবৎ অনবরত যুদ্ধ করিয়া সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করিয়াছিলেন। এই উক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। হর্ষবর্দ্ধন দাক্ষিণাত্যের রাজা পুলকেশীর হস্তে পরাজিত হইয়াছিলেন। আর্য্যাবর্তে অন্তত ৬১৯ খৃ. অব্দ পর্য্যন্ত শশাঙ্ক একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন। কারণ ঐ বৎসরে উত্তীর্ণ একখানি তাম্রশাসনে গঞ্জাম জিলাস্থিত কোঙ্গোদের শৈলোববংশীয় রাজা “চতুরুদধিসলিলবীচীমেখলা দ্বীপগিরিপত্তনবতী” বসুন্ধরার অধিপতি মহারাজাধিরাজ শ্রীশশাঙ্কের মহাসামন্ত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। শশাঙ্ক যে মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত মগধের অধিপতি ছিলেন হুয়েন সাংয়ের উক্তি হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়। কারণ হুয়েন সাংয়ের উক্তি অনুসারে ৬৩৭ খৃষ্টাব্দের অনতিকাল পূৰ্ব্বে শশাঙ্ক গয়ার বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন এবং নিকটবর্ত্তী একটি মন্দির হইতে বুদ্ধমূর্ত্তি সরাইতে আদেশ দেন; ইহার ফলে শশাঙ্কের সর্বাঙ্গে ক্ষত হয়, তাঁহার মাংস পচিয়া যায় এবং অল্পকাল মধ্যেই তাঁহার মৃত্যু হয়।
সুতরাং হর্ষবর্দ্ধন তাঁহার কঠোর প্রতিজ্ঞা ও বিরাট যুদ্ধসজ্জা সত্ত্বেও শশাঙ্কের বিশেষ কিছু অনিষ্ট করিতে পারেন নাই। শশাঙ্কের সহিত তাঁহার কোনো যুদ্ধ হইয়াছিল কি না তাহাও নিশ্চিত জানা যায় না। কেবলমাত্র আমঞ্জুশ্রীমূলকল্প নামক গ্রন্থে ইহার উল্লেখ আছে। এই বৌদ্ধ গ্রন্থখানি খুব প্রাচীন নহে। পুরাণের মতো এই গ্রন্থে ভবিষ্যৎ রাজাদের বিবরণ আছে। কিন্তু কোনো রাজার নামই পুরাপুরি দেওয়া নাই, হয় প্রথম অক্ষর অথবা সমার্থক কোনো শব্দ দ্বারা সূচিত করা হইয়াছে। এই গ্রন্থ ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করা যায় না, ইহা মধ্যযুগের কতকগুলি কিংবদন্তীর সমাবেশ মাত্র। এই গ্রন্থোক্ত রাজা ‘সোম’ সম্ভবত শশাঙ্ক এবং তাঁহার শত্রু হকারাখ্য রাজা ও তাঁহার রকারাখ্য জ্যেষ্ঠভ্রাতা যথাক্রমে হর্ষবর্দ্ধন ও রাজ্যবর্দ্ধন। এই অনুমান স্বীকার করিয়া লইলে এই গ্রন্থে আমরা নিম্নোক্ত বিবরণ পাই।
“এই সময়ে মধ্যদেশে বৈশ্যজাতীয় রাজ্যবর্দ্ধন রাজা হইবেন। তিনি শশাঙ্কের তুল্য শক্তিশালী হইবেন। নগ্নজাতীয় রাজার হস্তে তাঁহার মৃত্যু হইবে। অসাধারণ পরাক্রমশালী তাঁহার কনিষ্ঠভ্রাতা হর্ষবর্দ্ধন বহু সৈন্যসহ শশাঙ্কের রাজধানী পুণ্ড্রনগরীর বিরুদ্ধে অভিযান করেন। তিনি দুবৃত্ত শশাঙ্ককে পরাজিত করেন এবং ঐ বৰ্বর দেশে যথোপযুক্ত সম্মান না পাওয়ায় (মতান্তরে ‘পাইয়া’) স্বীয় রাজ্যে প্রত্যাবর্ত্তন করেন।”
এই উক্তি কত দূর সত্য বলা যায় না। কিন্তু ইহা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিলেও মাত্র ইহাই প্রমাণিত হয় যে হর্ষবর্দ্ধন শশাঙ্কের রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন কিন্তু বিশেষ কোনো সাফল্য লাভ করিতে না পারিয়া ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।
মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প মতে শশাঙ্ক মাত্র ১৭ বৎসর রাজত্ব করেন। কিন্তু ইহা সত্য নহে। শশাঙ্ক ৬.৬ অব্দের পূর্ব্বেই রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পূৰ্ব্বোদ্ধৃত হুয়েন সাংয়ের উক্তি হইতে প্রমাণিত হয় যে ৬৩৭ অব্দের অনতিকাল পূৰ্ব্বে তাঁহার মৃত্যু হয়। শশাঙ্কের যে তিনখানি লিপি পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার একখানির তারিখ ৬১৯ অব্দ। খুব সম্ভবত মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত শশাঙ্ক গৌড়, মগধ, দণ্ডভুক্তি, উৎকল ও কোঙ্গোদের অধিপতি ছিলেন।
শশাঙ্ক শিবের উপাসক ছিলেন। হুয়েন সাং তাঁহার বৌদ্ধবিদ্বেষ সম্বন্ধে অনেক গল্প লিখিয়াছেন কিন্তু এগুলি বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ হুয়েন সাংয়ের বর্ণনা হইতেই বেশ বোঝা যায় যে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণে এবং তাঁহার রাজ্যের সৰ্ব্বত্র বৌদ্ধধর্ম্মের বেশ প্রসার ও প্রতিপত্তি ছিল।
বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। তিনিই প্রথম আৰ্য্যাবর্তে বাঙ্গালীর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন এবং ইহা আংশিকভাবে কাৰ্য্যে পরিণত করেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবল মৌখরিরাজশক্তি তাঁহার কূটনীতি ও বাহুবলে সমূলে ধ্বংস হয়। সমগ্র উত্তরাপথের অধীশ্বর প্রবল শক্তিশালী হর্ষবর্দ্ধনের সমুদয় চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া তিনি বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার আধিপত্য বজায় রাখিয়াছিলেন। বাণভট্টের মতো চরিত-লেখক অথবা হুয়েন সাংয়ের মতো সুহৃৎ থাকিলে হয়ত হর্ষবর্দ্ধনের মতোই তাঁহার খ্যাতি চতুর্দিকে বিস্তৃত হইত। কিন্তু অদৃষ্টের নিদারুণ বিড়ম্বনায় তিনি স্বদেশে অখ্যাত এবং অজ্ঞাত; এবং শত্রুর কলঙ্ককালিমাই তাহাকে জগতে পরিচিত করিয়াছে।
০৫. অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায়
পঞ্চম পরিচ্ছেদ –অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায়