হর্ষচরিত্রের বিভিন্ন স্থানে এই ঘটনার যেরূপ উল্লেখ আছে, তাহাতে মনে হয় যে দেবগুপ্ত কান্যকুব্জ জয় করিয়াই শশাঙ্কের জন্য অপেক্ষা না করিয়া থানেশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। শশাঙ্ক কান্যকুজে পৌঁছিয়া এই সংবাদ শুনিয়া দেবগুপ্তের সাহায্যে অগ্রসর হন। কিন্তু এই দুই মিত্রশক্তি মিলিত হইবার পূর্ব্বেই রাজ্যবর্দ্ধন দেবগুপ্তকে পরাস্ত ও নিহত করেন। দেবগুপ্তের ন্যায় রাজ্যবর্দ্ধনও জয়োল্লাসে সমূহ-বিপদের আশঙ্কা না করিয়া নিজের ক্ষুদ্র সৈন্যের কতক বন্দী মালবসৈন্যের সঙ্গে থানেশ্বরে প্রেরণ করেন এবং অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া কান্যকুজের দিকে অগ্রসর হন। সম্ভবত পথে শশাঙ্কের সঙ্গে তাঁহার যুদ্ধ হয় এবং তিনি পরাস্ত ও নিহত হন।
শশাঙ্ক কর্ত্তৃক রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যার কথা আমরা তিনটি বিভিন্ন সূত্রে জানিতে পারি। হর্ষবর্দ্ধনের সভাকবি বাণভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থ, হর্ষবর্দ্ধনের পরম সুহৃদ চীনদেশীয় পরিব্রাজক হুয়েন সাংয়ের কাহিনী, এবং হর্ষবর্দ্ধনের শিলালিপি। বাণভট্ট লিখিয়াছেন যে মিথ্যা উপচারে আশ্বস্ত হইয়া রাজ্যবর্দ্ধন একাকী নিরস্ত্র শশাঙ্কের ভবনে গমন করেন এবং তৎকর্ত্তৃক নিহত হন। রাজ্যবর্দ্ধন কেন এইরূপ অসহায় অবস্থায় শত্রুর হাতে আত্মসমর্পণ করিলেন বাণভট্ট সে সম্বন্ধে একেবারে নীরব। হর্ষচরিতের টীকাকার শঙ্কর লিখিয়াছেন যে শশাঙ্ক তাঁহার কন্যার সহিত বিবাহের প্রলোভন দেখাইয়া রাজ্যবর্দ্ধনকে স্বীয় ভবনে আনয়ন করেন এবং রাজ্যবর্দ্ধন তাঁহার সঙ্গীগণসহ আহারে প্রবৃত্ত হইলে ছদ্মবেশে তাঁহাকে হত্যা করেন। শঙ্কর সম্ভবত চতুর্দ্দশ শতাব্দীর অথবা পরবর্ত্তীকালের লোক। যে ঘটনা বাণভট্ট উল্লেখ করেন নাই হাজার বৎসর পরে শঙ্কর কিরূপে তাঁহার সন্ধান পাইলেন জানি না। কিন্তু তাঁহার বর্ণনার সহিত বাণভট্ট কথিত এ নিরস্ত্রকারী’ রাজ্যবর্দ্ধনের মৃত্যুর কাহিনীর সামঞ্জস্য নাই।
হুয়েন সাং বলেন যে, শশাঙ্ক পুনঃপুন তাঁহার মন্ত্রীগণকে বলিতেন যে সীমান্ত রাজ্যে রাজ্যবর্দ্ধনের ন্যায় ধার্মিক রাজা থাকিলে নিজ রাজ্যের কল্যাণ নাই। এই কথা শুনিয়া শশাঙ্কের মন্ত্রীগণ রাজ্যবর্দ্ধনকে একটি সভায় আমন্ত্রণ করিয়া তাহাকে হত্যা করে। হুয়েন সাংয়ের এই উক্তি কোনোমতেই বিশ্বাসযোগ্য নহে। কারণ রাজ্যবর্দ্ধন সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই যুদ্ধযাত্রা করেন। তিনি ধার্মিক বা অধাৰ্মিক ইহা বিচার করিবার এবং এ বিষয়ে পুনঃপুন মন্ত্রীগণকে বলিবার সুযোগ বা সম্ভাবনা শশাঙ্কের ছিল না। অন্যত্র হুয়েন সাং লিখিয়াছেন, “রাজ্যবর্দ্ধনের মন্ত্রীগণের দোষেই রাজ্যবর্দ্ধন শক্তহস্তে নিহত হইয়াছেন-মন্ত্রীরাই ইহার জন্য দায়ী”। বাণভট্ট-কথিত ‘মিথ্যা উপচারে আশ্বস্ত রাজ্যবর্দ্ধনের একাকী নিরস্ত্র শশাঙ্কভবনে গমনের সহিত ইহার সঙ্গতি নাই।
হর্ষবর্দ্ধনের শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে যে সত্যানুরোধে রাজ্যবর্দ্ধন শক্ৰভবনে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন। এখানে শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ইঙ্গিতই নাই।
তিনটি সমসাময়িক বিবরণে একই ঘটনা সম্বন্ধে এই প্রকার বিরোধিতা দেখিলে স্বতই তাঁহার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। তারপর ইহাও উল্লেখযোগ্য যে বাণভট্ট ও হুয়েন সাং উভয়েই শশাঙ্কের পরম বিদ্বেষী এবং তাহাদের গ্রন্থের নানা স্থানে শশাঙ্ক সম্বন্ধে অশিষ্ট উক্তি ও অলীক কাহিনীতে এই বিদ্বেষভাব প্রকটিত হইয়াছে। সুতরাং কেবলমাত্র এই দুইজনের উক্তির উপর নির্ভর করিয়া শশাঙ্ক বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া রাজ্যবর্দ্ধনকে হত্যা করিয়াছিলেন, এই মত গ্রহণ করা সমীচীন নহে। যুদ্ধে নিরত দুই পক্ষের পরস্পরের প্রতি অভিযোগ প্রায়শই কত অমূলক বর্ত্তমানকালের দুইটি মহাযুদ্ধে তাঁহার বহু প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। এই প্রসঙ্গে শিবাজী কর্ত্তৃক আফজলখানের হত্যার কাহিনী উল্লেখযোগ্য। মহারাষ্ট্র গ্রন্থমতে আফজলখানই বিশ্বাসঘাতক, আবার মুসলমান ঐতিহাসিকেরা শিবাজী সম্বন্ধে ঐ অপবাদ ঘোষণা করেন। শশাঙ্ক সম্বন্ধে গৌড়দেশীয় কোনো লেখকের গ্রন্থ থাকিলে তাহাতে সম্ভবত রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যার সম্পূর্ণ বিভিন্ন রকম বিবরণই পাওয়া যাইত।
এই প্রসঙ্গে রোম সম্রাট ভ্যালেরিয়ানের উল্লেখ করা যাইতে পারে। কাহারও মতে, ভ্যালেরিয়ান যখন পারস্যের রাজার সহিত সন্ধির কথাবার্তা চালাইতেছিলেন, তখন পারস্যের রাজা তাঁহাকে আমন্ত্রণ করেন এবং সাক্ষাৎ হইলে বন্দী করেন। অপর মত অনুসারে ভ্যালেরিয়ান অল্প সৈন্য লইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন এবং পারস্যরাজের হস্তে পরাজিত ও বন্দী হইয়াছিলেন। কেহ কেহ বলেন যে এক অবরুদ্ধ দুর্গে অবস্থানকালে স্বীয় বিদ্রোহী সৈন্যের হস্ত হইতে আত্মরক্ষার জন্য তিনি পলাইয়া পারস্যরাজের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। অসম্ভব নহে যে অনুরূপ কোনো কারণেই রাজ্যবর্দ্ধন শশাঙ্কের বন্দী হইয়াছিলেন। বাণভট্ট নিজেই বলিয়াছেন যে মাত্র দশ সহস্র সৈন্য লইয়া তিনি মালবরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে কতক মালবরাজের সহিত যুদ্ধে হতাহত হইয়াছিল এবং কতক বন্দী মালব সৈন্যসহ থানেশ্বরে প্রেরিত হইয়াছিল। শশাঙ্ক যে দশ সহস্রের অনধিক সৈন্য লইয়া সুদূর কান্যকুজে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন, এইরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। অপরপক্ষে রাজ্যবর্দ্ধন বৌদ্ধ ছিলেন। পরবর্ত্তীকালে হর্ষবর্দ্ধনের বৌদ্ধধর্ম্মের প্রতি অনুরাগের জন্য তাঁহার প্রজাগণ তাঁহার প্রাণনাশের জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। সুতরাং রাজ্যবর্দ্ধনের মন্ত্রীগণও যে কৌশলে তাঁহার হত্যাসাধনে সহায়তা করিবেন, ইহা একেবারে অবিশ্বাস্য নহে। “রাজ্যবর্দ্ধনের মৃত্যুর জন্য তাঁহার মন্ত্রীগণই দায়ী” হুয়েন সাংয়ের এই উক্তি এই অনুমানের পরিপোষক। যুদ্ধে পরাজয় অথবা মন্ত্রীগণের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে যদি রাজ্যবর্দ্ধন নিহত হইয়া থাকেন, তবে হর্ষবর্দ্ধনের পক্ষীয় লেখক যে এই কলঙ্কের উল্লেখ করিবেন না ইহাই খুব স্বাভাবিক। সুতরাং কেবলমাত্র বাণভট্ট ও হুয়েন সাংয়ের পরস্পরবিরোধী, অস্বাভাবিক, অস্পষ্ট উক্তি এবং অসম্পূর্ণ কাহিনীর উপর নির্ভর করিয়া শশাঙ্ককে বিশ্বাসঘাতক হত্যাকারীরূপে গ্রহণ করা কোনো ক্রমেই যুক্তিসিদ্ধ নহে।