.
৩. গৌড় রাজ্য
গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের পর পরবর্ত্তী ‘গুপ্তবংশ’ নামে পরিচিত এক বংশের গুপ্ত উপাধিধারী রাজগণ এই সাম্রাজ্যের এক অংশ অধিকার করিয়াছিলেন। খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কতকাংশ এই রাজবংশের অধীন ছিল। এই সময়ে বাংলা দেশে এই অঞ্চল গৌড় নামে প্রসিদ্ধ হয়। নামত গুপ্তরাজগণের অধীন হইলেও ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে গৌড় একটি বিশিষ্ট জনপদরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। তখন মৌখরি বংশ বর্ত্তমান যুক্তপ্রদেশে রাজত্ব করিতেন। এই বংশের পরাক্রান্ত রাজা ঈশানবর্ম্মা সম্বন্ধে তাঁহার একখানি শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে যে তিনি গৌড়গণকে পরাজিত ও বিপর্যস্ত করিয়া তাহাদিগকে সমুদ্রে আশ্রয় লইতে বাধ্য করেন। ইহার অর্থ সম্ভবত এই যে গৌড়ের অধিবাসীগণ সমুদ্রতীরে যাইয়া আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে ইহাতে বাঙ্গালীর নৌবলের সাহায্যে আত্মরক্ষা অথবা সমুদ্র লঙ্নপূৰ্ব্বক অন্য দেশে যাইয়া বাসস্থানের ইঙ্গিত করা হইয়াছে। সে যাহাই হউক, সমুদ্রের উল্লেখ হইতে মনে হয় যে তখন সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ গৌড়ের অন্তর্গত ছিল।
মৌখরি ও পরবর্ত্তী গুপ্তবংশীয় রাজগণের মধ্যে পুরুষানুক্রমিক বিবাদ চলিতেছিল। ঈশানবর্ম্মা কর্ত্তৃক গৌড় বিজয় এই বিবাদের ইতিহাসে একটি ক্ষুদ্র অধ্যায়মাত্র। গুপ্তরাজগণের শিলালিপি অনুসারে গুপ্তরাজ কুমারগুপ্ত ঈশানবর্ম্মাকে পরাজিত করেন এবং কুমারগুপ্তের পুত্র দামোদরগুপ্ত মৌখরিদের সহিত যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ঈশানবর্ম্মার পরবর্ত্তী মৌখরিরাজ শৰ্ব্ববর্ম্মা ও অবন্তিবর্ম্মা সম্ভবত মগধের কিয়দংশ অধিকার করেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে ইহার ফলে গুপ্তরাজগণ মগধ ও গৌড় পরিত্যাগ করিয়া মালবে রাজত্ব করেন। কিন্তু ইহা সত্য হউক বা না হউক, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে যে গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্তের রাজ্য পূৰ্ব্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। সুতরাং গৌড় ও মগধ তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অর্দ্ধশতাব্দীব্যাপী এই সংঘর্ষের ফলে এবং উত্তর হইতে তিব্বতীয়দের এবং দক্ষিণ হইতে চালুক্যরাজ্যের আক্রমণে সম্ভবত পরবর্ত্তী গুপ্তরাজগণ হীনবল হইয়া পড়েন এবং এই সুযোগে গৌড়দেশে শশাঙ্ক এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
.
৪. শশাঙ্ক
বাঙ্গালী রাজগণের মধ্যে শশাঙ্কই প্রথম সাৰ্বভৌম নরপতি। তাঁহার বংশ বা বাল্যজীবন সম্বন্ধে সঠিক কিছুই জানা যায় না। কেহ কেহ মতপ্রকাশ করিয়াছেন যে শশাঙ্কের অপর নাম নরেন্দ্র গুপ্ত এবং তিনি গুপ্তরাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু এই মতটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলিয়াই মনে হয়। প্রাচীন রোহিতাশ্বের (রোটাসগড়) গিরিগাত্রে শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক এই নামটি ক্ষোদিত আছে। যদি এই শশাঙ্ক ও গৌড়রাজ শশাঙ্ককে অভিন্ন বলিয়া গ্রহণ করা যায়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয় যে, শশাঙ্ক প্রথমে একজন মহাসামন্ত মাত্র ছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে শশাঙ্ক মৌখরিরাজ্যের অধীনস্থ সামন্তরাজা ছিলেন। কিন্তু পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে যে ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাবে গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্ত মগধ ও গৌড়ের অধিপতি ছিলেন। সুতরাং শশাঙ্ক এই মহাসেনগুপ্তের অধীনে মহাসামন্ত ছিলেন, এই মতই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়।
৬০৬ অব্দের পূর্ব্বেই শশাঙ্ক একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। তাঁহার রাজধানী কর্ণসুবর্ণ খুব সম্ভবত মুর্শিদাবাদ জেলায় বহরমপুরের ছয় মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে রাঙ্গামাটি নামক স্থানে অবস্থিত ছিল। শশাঙ্ক দক্ষিণে দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর জেলা), উল্কল, ও গঞ্জাম জেলায় অবস্থিত কোঙ্গোদ রাজ্য জয় করেন। উৎকল ও দণ্ডভুক্তি তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শৈলোদ্ভব বংশীয় রাজগণ তাঁহার অধীনস্থ সামন্তরূপে কোঙ্গোদ শাসন করিতেন। পশ্চিমে মগধ রাজ্যও শশাঙ্ক জয় করেন। দক্ষিণবঙ্গে যে স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের কথা পূৰ্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে, সম্ভবত তাহাও শশাঙ্কের অধীনতা স্বীকার করে। কিন্তু এ সম্বন্ধে সঠিক কিছু বলা যায় না।
শশাঙ্কের পূৰ্ব্বে আর কোনো বাঙ্গালী রাজা এইরূপ বিস্তৃত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন বলিয়া জানা নাই। কিন্তু শশাঙ্ক ইহাতেই সন্তুষ্ট হন নাই। তিনি গৌড়ের চিরশত্রু মৌখরিদিগকে দমন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন।
মৌখরিরাজ গ্রহবর্ম্মা পরাক্রান্ত স্থাণীশ্বরের (থানেশ্বর) রাজা প্রভাকরবর্দ্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। কামরূপরাজ ভাস্করবর্ম্মাও শশাঙ্কের ভয়ে থানেশ্বররাজের সহিত মিত্রতা স্থাপন করেন। শশাঙ্কও এই দুই মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য মালবরাজ দেবগুপ্তের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন।
কী কারণে এই দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ উপস্থিত হয় এবং এই যুদ্ধের প্রথম ভাগের বিবরণ নিশ্চিত জানা যায় না। শশাঙ্ক সম্ভবত প্রথমে বারাণসী অধিকার করিয়া পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন এবং দেবগুপ্তও মালব হইতে সসৈন্যে কান্যকুব্জ (কনৌজ) যাত্রা করেন। ইহার পরবর্ত্তী ঘটনা সম্বন্ধে সমসাময়িক ‘হর্ষচরিত গ্রন্থে নিম্নলিখিত বিবরণ পাওয়া যায়।
‘থানেশ্বররাজ প্রভাকরবর্দ্ধনের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্দ্ধন সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। এমন সময় কান্যকুব্জ হইতে দূত আসিয়া সংবাদ দিল যে মালবের রাজা কান্যকুব্জরাজ গ্রহবর্ম্মাকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করিয়া রাণী রাজশ্রীকে কারারুদ্ধ করিয়াছেন এবং থানেশ্বর আক্রমণের উদ্যোগ করিতেছেন। এই নিদারুণ সংবাদ শুনিয়া রাজ্যবর্দ্ধন কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্দ্ধনের উপর রাজ্যভার ন্যস্ত করিয়া অবিলম্বে দশ সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য মাত্র লইয়া ভগিনীর উদ্ধারের নিমিত্ত অগ্রসর হইলেন। পথে মালবরাজের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। তিনি মালবকে পরাজিত করিয়া তাঁহার বহু সৈন্য বন্দী করিয়া থানেশ্বরে প্রেরণ করিলেন। কিন্তু কান্যকুজে পৌঁছিবার পূর্ব্বেই শশাঙ্কের হস্তে তাঁহার মৃত্যু হয়।’