প্রাচীন দিল্লীতে কুতবমিনারের নিকটে একটি লৌহস্তম্ভ আছে। এই স্তম্ভগাত্রে ক্ষোদিত লিপি হইতে জানা যায় যে চন্দ্র নামক একজন রাজা বঙ্গের সম্মিলিত রাজশক্তিকে পরাজিত করিয়াছিলেন। এই চন্দ্র কে এবং কোথায় রাজত্ব করিতেন, তৎসম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কাহারও কাহারও মতে, তিনি গুপ্তসম্রাট প্রথম অথবা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। প্রথমোক্ত অনুমান স্বীকার করিলে বলিতে হয় যে সমুদ্রগুপ্তের পূর্ব্বেই তাঁহার পিতা বঙ্গদেশ জয় করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় অনুমান অনুসারে সমুদ্রগুপ্তের বঙ্গ জয়ের পরেও তাঁহার পুত্রকে আবার বঙ্গদেশ জয় করিতে হইয়াছিল। খুব সম্ভবত লৌহস্তম্ভে উল্লিখিত রাজা চন্দ্র গুপ্তবংশীয় সম্রাট নহেন। এ সম্বন্ধে অন্য যে সমুদয় মতবাদ প্রচলিত তাঁহার সবিস্তারে উল্লেখ করার প্রয়োজন নাই। কিন্তু রাজা চন্দ্র যিনিই হউন, দিল্লীর স্তম্ভলিপি হইতে প্রমাণিত হয় যে গুপ্তযুগের প্রাক্কালে বঙ্গে একাধিক স্বাধীন রাজ্য ছিল এবং আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন হইলে তাহারা সম্মিলিত হইয়া বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিত।
সমতট প্রথমে করদরাজ্য হইলেও ক্রমে ইহা গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং সমস্ত বাংলা দেশই পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্তসাম্রাজ্যের অংশমাত্র ছিল। উত্তরবঙ্গে এই যুগের কয়েকখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। এগুলি হইতে জানা যায় যে, বঙ্গদেশের এই অংশ পুণ্ড্রবর্দ্ধন-ভুক্তি নামক বিভাগের অন্ত ভুক্ত এবং গুপ্তসম্রাট কর্ত্তৃক নিযুক্ত এক শাসনকর্ত্তার অধীনে ছিল। এই ভুক্তি বা বিভাগ কতকগুলি বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল। ৫৪৪ খৃষ্টাব্দে গুপ্তবংশীয় সম্রাট স্বীয় পুত্রকে এই ভুক্তির শাসনকর্ত্তার পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন। ৫০৭ অব্দে পূৰ্ব্ববঙ্গ অথবা সমতট মহারাজ বৈন্যগুপ্ত শাসন করিতেন। তাঁহার রাজধানী ছিল ক্রীপুর। তিনি পরে নিজ নামে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত করিয়াছিলেন এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি গুপ্তবংশীয় ছিলেন এবং প্রথমে বঙ্গের শাসনকর্ত্তা হইলেও পরে গুপ্তসাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। দক্ষিণ ও পশ্চিমবঙ্গে গুপ্তরাজাগণের শাসনপ্রণালী কিরূপ ছিল, তাহা জানা যায় না।
.
২. স্বাধীন বঙ্গরাজ্য
অন্তর্বিদ্রোহ ও হূণজাতির পুনঃপুন আক্রমণের ফলে খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে গুপ্তসম্রাটগণ হীনবল হইয়া পড়েন। এই সময়ে যশোধর্ম্মণ নামে এক দুর্ধর্ষ বীর সমগ্ৰ আৰ্য্যাবৰ্ত্তে আপনার প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁহার জয়স্তম্ভে উল্লিখিত হইয়াছে যে তিনি পূর্ব্বে ব্রহ্মপুত্র নদ হইতে পশ্চিমে আরবসাগর এবং উত্তরে হিমালয় হইতে দক্ষিণে মহেন্দ্রগিরি (গঞ্জাম জিলায় অবস্থিত) পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত রাজ্য জয় করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রশস্তিকারের এই উক্তি সত্য বলিয়া গ্রহণ করিলে বাংলা দেশও তাঁহার অধীনস্থ ছিল, একথা স্বীকার করিতে হয়। যশোধর্ম্মণের রাজ্য দীর্ঘকাল স্থায়ী না হইলেও ইহার ফলে গুপ্তসাম্রাজ্যের ধ্বংস আরম্ভ হয়। এই সময় এবং সম্ভবত এই সুযোগে দক্ষিণ ও পূৰ্ব্ববঙ্গ গুপ্তসম্রাটগণের অধীনতাপাশ ছিন্ন করিয়া একটি পরাক্রান্ত স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। কোটালিপাড়ার পাঁচখানি এবং বর্দ্ধমান জিলার অন্তর্গত মল্লসারুলে প্রাপ্ত একখানি তাম্রশাসনে এই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যর কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। এই ছয়টি তাম্রশাসনে গোপচন্দ্র, ধৰ্ম্মাদিত্য ও সমাচারদেব এই তিনজন রাজার নাম পাওয়া যায়। ইহারা সকলেই মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। সমাচারদেবের স্বর্ণমুদ্রা এবং নালন্দার ধ্বংসাবশেষ মধ্যে তাঁহার নামাঙ্কিত শাসনমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। সুতরাং তাহারা যে বেশ শক্তিশালী স্বাধীন রাজা ছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। সমগ্র দক্ষিণ এবং পূৰ্ব্ব ও পশ্চিমবঙ্গের অন্তত কতকাংশ এই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই যুগের আরও কতকগুলি স্বর্ণমুদ্রা বাংলা দেশের নানা স্থানে আবিষ্কৃত হইয়াছে। সম্ভবত পূর্ব্বোক্ত স্বাধীন বঙ্গদেশের রাজগণই এগুলি প্রচলিত করিয়াছিলেন। এই সমুদয় মুদ্রায় যে সকল রাজার নাম আছে, তাঁহার মধ্যে মাত্র দুইটি অনেকটা নিশ্চিতরূপে পড়া যায়। একটি পৃথুবীর অপরটি শ্রীসুধন্যাদিত্য।
এই সমুদয় রাজাই একবংশীয় কি না তাহা বলা কঠিন। যে সমুদয় রাজার নাম পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার মধ্যে গোপচন্দ্ৰই সৰ্ব্বপ্রাচীন ছিলেন বলিয়া মনে হয়। তিনি অন্তত ১৮ বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁহার পর ধৰ্ম্মাদিত্য ও সমাচারদেব যথাক্রমে অন্তত ৩ ও ১৪ বৎসর রাজত্ব করেন। সম্ভবত এই তিনজন রাজা খৃষ্টীয় ৫২৫ হইতে ৫৭৫ অব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন। দুঃখের বিষয়, এই রাজাদের সম্বন্ধে বিশেষ কোনো বিবরণই জানা যায় না। এমনকি তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে কী সম্বন্ধ ছিল, তাহাও নির্ণয় করিবার উপায় নাই। তবে তাঁহাদের তাম্রশাসনগুলি পড়িলে মনে হয় যে তাঁহাদের অধীনে স্বাধীন বঙ্গরাজ্য প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সমৃদ্ধিশালী ছিল।
কোন সময়ে কিভাবে এই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের অবসান হয়, তাহা বলা যায়। দাক্ষিণাত্যের চালুক্যরাজ কীৰ্ত্তিবৰ্মণ ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষপাদে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ ও মগধ জয় করেন বলিয়া তাঁহার প্রশস্তিকারেরা উল্লেখ করিয়াছেন। চালুক্যরাজের আক্রমণের ফলেই হয়তো বঙ্গরাজ্য দুৰ্বল হইয়া পড়িয়াছিল। তবে খুব সম্ভবত স্বাধীন গৌড়রাজ্যের অভ্যুদয়ই ইহার পতনের প্রধান কারণ।