যদি পাটলিপুত্রের নন্দরাজ ও যবন লেখকগণ বর্ণিত গঙ্গরিডইর রাজা অভিন্ন বলিয়া ধরা যায়-তাহা হইলে খৃষ্টপূর্ব্ব চতুর্থ শতাব্দী বাংলার ইতিহাসের এক গৌরবময় যুগ বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। এই মতবাদ গ্রহণ না করিলেও ৩২৭ খ্র. পূ. বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। কারণ, বঙ্গ ও মগধ এই যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনা ও আর্য্যাবর্তে তাঁহার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা একটি মহৎ কীর্তি। অঙ্গাধিপ কর্ণ সম্ভবত যাহার সূচনা করেন এবং সহস্রাধিক বৎসর পরে শশাঙ্ক ও ধর্ম্মপালের অধীনে যাহার পুনরাবৃত্তি হয়, মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পূর্ব্বে অজ্ঞাতনামা বাংলা দেশের এক রাজা বাহুবলে সেই অপূৰ্ব্ব কীৰ্ত্তি অর্জন করিয়া বিশ্ববিজয়ী যবনবীর আলেকজাণ্ডারের বিস্ময় সম্ভ্রম ও আশঙ্কার সৃষ্টি করিয়াছিলেন। দুঃখের বিষয় বিদেশীয় লেখকগণের কয়েকটি সম্ভমসূচক উক্তি ব্যতীত ইহার পরবর্ত্তী যুগের বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে আর কিছুই জানা যায় না। বাংলার এই অন্ধকারময় যুগে বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন, গ্রীক শক পুতুব কুষাণ প্রভৃতি বিদেশী জাতির আক্রমণ, দাক্ষিণাত্যে শাতবাহন রাজ্যের অভ্যুদয় এবং আর্য্যাবর্তে বহু খণ্ডাজ্যের উদ্ভব হয়। বাংলা দেশ সম্ভবত মৌৰ্য্য রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং হয়ত কুষাণ রাজও ইহার কিয়দংশ অধিকার করিয়াছিলেন। কিন্তু এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কোনো সংবাদ জানা যায় না। আলেকজাণ্ডারের অভিযানের চারি পাঁচশত বৎসর পরে লিখিত পেরিপ্লাস গ্রন্থ ও টলেমীর বিবরণ হইতে আমরা জানিতে পারি যে খৃষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে বাংলায় স্বাধীন গঙ্গরিডই রাজ্য বেশ প্রবল ছিল এবং গঙ্গাতীরবর্ত্তী গঙ্গে নামক নগরী ইহার রাজধানী ছিল। এই গঙ্গে নগরী একটি প্রসিদ্ধ বন্দর ছিল, এবং বাংলার সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় এখান হইতে সুদূর পশ্চিম দেশে রপ্তানি হইত। এই সংবাদটুকু ছাড়া খৃষ্টজন্মের পূর্ব্বে ও পরের তিন শত-মোট ছয় শত বৎসরের বাংলার ইতিহাস নিবিড় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। বিদেশীয় ঐতিহাসিকগণ যে গঙ্গরিডই জাতির সাম্রাজ্য ও ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হইয়া তাহাদিগকে ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, মহাকবি ভার্জিল যে জাতির শৌর্য-বীর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়াছেন এবং পঞ্চ শতাধিক বৎসর যাঁহারা বাংলা দেশে রাজত্ব করিয়াছেন-এদেশীয় পুরাণ বা অন্য কোনো গ্রন্থে সে জাতির কোনোই উল্লেখ নাই।
০৪. গুপ্ত-যুগ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ –গুপ্ত-যুগ
১. গুপ্ত-শাসন
খৃষ্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্তবংশীয় রাজগণ ভারতে বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই বংশের আদিপুরুষ শ্রীগুপ্ত খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষে অথবা চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভে কোনো ক্ষুদ্র রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। তাঁহার পৌত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত প্রপৌত্র সমুদ্রগুপ্ত বহু দেশ জয় করিয়া একটি বিরাট সাম্রাজ্য গঠন করেন। এই সাম্রাজ্য ক্রমে বঙ্গদেশ হইতে কাঠিয়াবার পর্য্যন্ত বিস্তৃত হয়।
আদিম গুপ্তরাজ্য কোথায় অবস্থিত ছিল, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন যে শ্রীগুপ্ত মগধে রাজত্ব করিতেন। কিন্তু চীনদেশীয় পরিব্রাজক ইৎসিং লিখিয়াছেন যে মহারাজ শ্রীগুপ্ত চীনদেশীয় শ্রমণদের জন্য মৃগস্থাপন স্তূপের নিকটে একটি মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন। একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে মৃগস্থাপন স্কুপ বরেন্দ্রে অবস্থিত ছিল। সুতরাং মহারাজ শ্রীগুপ্ত যে বরেন্দ্রে অথবা তাঁহার সমীপবর্ত্তী প্রদেশে রাজত্ব করিতেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কেহ কেহ অনুমান করেন যে ইৎসিং বর্ণিত এই শ্রীগুপ্তই গুপ্তরাজবংশের আদিপুরুষ। ইৎসিং বলেন যে শ্রীগুপ্ত পাঁচশত বৎসর পূর্ব্বে রাজত্ব করিতেন। তাহা হইলে শ্রীগুপ্তের রাজ্যকাল দ্বিতীয় শতাব্দের শেষভাগে পড়ে। কিন্তু ইৎসিং-কথিত পাঁচশত বৎসর মোটামুটিভাবে ধরিলে তল্লিখিত শ্রীগুপ্তকে গুপ্তরাজগণের আদিপুরুষ বলিয়া গণ্য করা যায় এবং অনেক পণ্ডিতই এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। এই মত অনুসারে বঙ্গদেশের এক অংশ আদিম গুপ্তরাজ্যের অন্তর্গত ছিল। কেহ কেহ অনুমান করেন যে গুপ্তগণ বাঙ্গালী ছিলেন এবং প্রথমে বাংলা দেশেই রাজত্ব করিতেন। কিন্তু ইহার সমর্থক কোনো প্রমাণ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত যখন বিশাল গুপ্তসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তখন বাংলা দেশে কতকগুলি স্বাধীন রাজ্য ছিল। বাঁকুড়ার নিকটবর্ত্তী সুসুনিয়া নামক স্থানে পৰ্বতগাত্রে ক্ষোদিত একখানি লিপিতে পুষ্করণের অধিপতি সিংহবর্ম্মা ও তাঁহার পুত্র চন্দ্রবর্ম্মার উল্লেখ আছে। সুসুনিয়ার ২৫ মাইল উত্তর-পূৰ্ব্বে দামোদর নদের দক্ষিণ তটে পোর্ণা নামে একটি গ্রাম আছে। এখানে খুব প্রাচীনকালের মূর্ত্তি ও অন্যান্য দ্রব্য পাওয়া গিয়াছে। খুব সম্ভবত ইহাই সিংহবর্ম্মা ও চন্দ্রবর্ম্মার প্রাচীন রাজধানী পুষ্করণের ধ্বংসাবশেষ। চন্দ্রবর্ম্মার রাজ্য কত দূর বিস্তৃত ছিল বলা যায় না। ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত কোটালিপাড়ায় চন্দ্রবর্ম্মকোট নামক একটি দুর্গ ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর শিলালিপিতে ইহার উল্লেখ আছে। কেহ কেহ অনুমান করেন যে উল্লিখিত চন্দ্ৰবৰ্ম্মার নাম অনুসারেই এই দুর্গের ঐরূপ নামকরণ হইয়াছিল। এই মত অনুসারে চন্দ্রবর্ম্মার রাজ্য বাঁকুড়া হইতে ফরিদপুর পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সমুদ্রগুপ্ত যে সমুদয় রাজাকে পরাজিত করিয়া আৰ্য্যাবর্তে সাম্রাজ্য বিস্তার করেন, তাঁহাদের মধ্যে একজনের নাম চন্দ্রবর্ম্মা। খুব সম্ভবত ইনিই পুষ্করণাধিপতি চন্দ্রবর্ম্মা এবং ইহাকে পরাজিত করিয়াই সমুদ্রগুপ্ত পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলা অধিকার করেন। বাংলা দেশের উত্তর ভাগ সম্ভবত গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কারণ সমুদ্রগুপ্তের শিলালিপিতে কামরূপ (বর্ত্তমান আসাম) গুপ্তসাম্রাজ্যের সীমান্তস্থিত করদরাজ্যরূপে বর্ণিত হইয়াছে।