এইরূপে যে দিকে দৃষ্টিপাত করা যায়, প্রাচীন যুগের বাঙ্গালীর কীৰ্ত্তি ও মহিমা আমাদের নয়ন-সম্মুখে উদ্ভাসিত হইয়া ওঠে। আমাদের ধারাবাহিক ইতিহাস না থাকিলেও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকটি বিবরণ হইতে সেকালের যে পরিচয় পাওয়া যায়, বাঙ্গালীমাত্রেরই তাহাতে গৌরব বোধ করার যথেষ্ট কারণ আছে। এই স্বল্প পরিচয়টুকু দিবার জন্যই এই গ্রন্থের আয়োজন। হয়ত ইহার ফলে বাঙ্গালীর মনে অতীত ইতিহাস জানিবার প্রবৃত্তি জন্মিবে এবং সমবেত চেষ্টার ফলে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা সম্ভবপর হইবে।
আমরা এই গ্রন্থে বাঙ্গালী এই সাধারণ সংজ্ঞা ব্যবহার করিয়াছি। কিন্তু যে যুগের কাহিনী এই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হইয়াছে, সে যুগের বাঙ্গালী আর আজিকার বাঙ্গালী ঠিক একই অর্থ সূচিত করে না। যে ভূখণ্ড আজ বঙ্গদেশ বলিয়া পরিচিত, প্রাচীন যুগে তাঁহার বিশিষ্ট কোনো একটি নাম ছিল না এবং তাঁহার ভিন্ন ভিন্ন অংশ ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত হইত, একথা গ্রন্থারম্ভেই বলিয়াছি। আজ যে ছয় কোটি বাঙ্গালী একটি বিশিষ্ট জাতিতে পরিণত হইয়াছে, ইহার মূলে আছে ভাষার ঐক্য এবং দীর্ঘকাল একই দেশে এক শাসনাধীনে বসবাস। ধর্ম্ম ও সমাজগত গুরুতর প্রভেদ সত্ত্বেও এই দুই কারণে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অধিবাসী হইতে পৃথক হইয়া বাঙ্গালী একটি বিশিষ্ট জাতি বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে। যে প্রাচীন যুগের কথা আমরা আলোচনা করিয়াছি, সে যুগের বাংলায় এমন একটি স্বতন্ত্র বিশিষ্ট প্রাদেশিক ভাষা গড়িয়া ওঠে নাই, যাহা সাহিত্যের বাহনরূপে গণ্য হইতে পারে সুতরাং তখন সারা বাংলার প্রচলিত ভাষা মোটামুটি এক এবং অন্যান্য প্রদেশের ভাষা হইতে পৃথক হইলেও তাহা জাতীয়তা গঠনের বিশেষ সহায়তা করিয়াছিল, এইরূপ মনে হয় না। সমগ্র বাংলা পাল ও সেনরাজগণের রাজ্যকালে তিন-চারিশত বৎসর যাবৎ মোটামুটি একই শাসনের অধীনে থাকিলেও কখনো এক দেশ বলিয়া বিবেচিত হয় নাই। হিন্দু যুগের শেষ পর্য্যন্ত গৌড় ও বঙ্গ দুইটি পৃথক দেশ সূচিত করিত। ইহার প্রত্যেকটিরই সীমা ক্রমশ ব্যাপক হইতে হইতে সমগ্র বাংলা দেশ তাঁহার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল-কিন্তু হিন্দু যুগের অবসানের পূর্ব্বে তাহা হয় নাই। তখন পর্য্যন্ত সমগ্র বাংলা দেশের কোনো একটি ভৌগোলিক সংজ্ঞা গড়িয়া ওঠে নাই। কঠোর জাতিভেদ প্রথা তখন ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য জাতির মধ্যে একটি সুদৃঢ় ব্যবধানের সৃষ্টি করিয়াছিল, এবং বাংলার ব্রাহ্মণ সম্ভবত বাংলার অন্য জাতির অপেক্ষা ভারতের অন্যান্য প্রদেশস্থ ব্রাহ্মণের সহিত অধিকতর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে সম্বদ্ধ ছিল। এই সমুদয় কারণে মনে হয় যে, হিন্দু যুগে বাঙ্গালী অর্থাৎ সমগ্র বাংলা দেশের অধিবাসী একটি বিশিষ্ট জাতিতে পরিণত হয় নাই।
কিন্তু তখন গৌড়বঙ্গের অধিবাসীরা যে দ্রুতগতিতে এক জাতিতে পরিণত হইবার দিকে অগ্রসর হইতেছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। দীর্ঘকাল এক রাজ্যের অধীনে এবং পরস্পরের পাশাপাশি বাস করিবার ফলে, তাহাদের সম্বন্ধ ক্রমশই ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিতেছিল এবং তাহারা ভারতের অন্যান্য প্রদেশ হইতে পৃথক হইয়া কতকগুলি বিষয়ে বিশিষ্ট স্বাতন্ত্র অবলম্বন করিতেছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ তাহাদের মৎস্য-মাংস-ভোজন, কোনো প্রকার শিরোভূষণের অব্যবহার, তান্ত্রিক মত ও শক্তিপূজার প্রাধান্য, প্রাচীন বঙ্গভাষা ও লিপির উৎপত্তি এবং শিল্পের বৈশিষ্ট্য প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে। এ সমুদয়ই তাহাদিগকে নিকটবর্ত্তী অন্যান্য প্রদেশের অধিবাসী হইতে পৃথক করিয়া একটি বৈশিষ্ট্য দান করিয়াছিল। এই বৈশিষ্ট্যের ফলেই, হিন্দু যুগের অবসানের অনতিকাল পরেই, তাহারা একটি জাতিতে পরিণত হইয়াছিল এবং ক্রমে তাহাদের এক নাম ও সংজ্ঞার সৃষ্টি হইয়াছিল। বিদেশীয় তুরস্করাজগণ তাহাদের এই জাতীয় বৈশিষ্ট লক্ষ্য করিয়া তাহাদিগকে একই নামে অভিহিত করেন। ইহারই ফলে গৌড় ও বঙ্গালদেশ মুসলমান যুগে সমগ্র বাংলা দেশের নামস্বরূপ ব্যবহৃত হয় এবং গৌড়ীয়’ ও ‘বাঙ্গালী’ সমগ্র দেশবাসীর পক্ষে প্রযোজ্য এই দুইটি জাতীয় নামের সৃষ্টি হয়। ইহাই বাঙ্গালী জাতির উৎপত্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।