প্রকৃত ইতিহাস বলিতে আমরা যাহা বুঝি, প্রাচীন বাংলার সেরূপ ইতিহাস লেখার সময় এখনো আসে নাই। কখনো আসিবে কি না তাহাও বলা যায় না। আমাদের দেশে এই যুগে লিখিত কোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ নাই। সুতরাং বিদেশীয় লেখকের বিবরণ এবং প্রাচীন লিপি, মুদ্রা ও অতীতের অন্যান্য স্মৃতিচিহ্নই এই ইতিহাস রচনার প্রধান উপকরণ। এ পর্য্যন্ত যে সমুদয় উপকরণ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাঁহার সাহায্যে যত দূর সম্ভব পুরাতন ঐতিহাসিক কাহিনী বিবৃত করিয়াছি। কিন্তু ইহা বাংলার ইতিহাস নহে, তাঁহার কঙ্কালমাত্র। ভূগর্ভে নিহিত অন্যান্য প্রাচীন লিপি, মুদ্রা প্রভৃতি অথবা রামচরিতের ন্যায় গ্রন্থ বহু সংখ্যায় আবিষ্কৃত হইলে হয়ত এই ইতিহাসের কঙ্কালে রক্তমাংসের যোজনা করিয়া ইহাকে সুগঠিত আকার প্রদান করা সম্ভবপর হইবে। কিন্তু তাহা কত দিনে হইবে, অথবা কখনো হইবে কি না, তাহা কেহ বলিতে পারে না।
আজ বাংলার ইতিহাসের উপকরণ পরিমাণে মুষ্টিমেয়। কিন্তু মুষ্টি হইলেও ইহা ধূলিমুষ্টি নহে, স্বর্ণমুষ্টি। ইহার সাহায্যে আমরা বাঙ্গালীর রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধৰ্ম্মজীবনের প্রকৃতি, গতি ও ক্রমবিবর্ত্তন জানিতে পারি না, এমনকি তাঁহার সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণাও করিতে পারি না, একথা সত্য। কিন্তু তথাপি এই সমুদয় সম্বন্ধে যে ক্ষীণ আভাস বা ইঙ্গিত পাই, তাঁহার মূল্য খুবই বেশি। আমাদের দেশের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা যে কত গভীর ছিল, এবং গত একশত বৎসরে এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান কত দূর অগ্রসর হইয়াছে, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রণীত রাজাবলী গ্রন্থের সহিত এই ইতিহাসের তুলনা করিলেই তাহা বুঝা যাইবে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কতকগুলি নিছক গল্প ও অলীক কাহিনীই ইতিহাস নামে প্রচলিত ছিল। বাঙ্গালীর অতীত কীর্তি বিস্মৃতির নিবিড় অন্ধকারে ডুবিয়া গিয়াছিল।
আজ ইতিহাসের একটু টুকরামাত্র আমরা জানি। কিন্তু হীরার টুকরার মতোই ইহার ভাস্করদীপ্তি অতীতের অন্ধকার উজ্জ্বল করিয়াছে। বিজয়সিংহের কাল্পনিক সিংহল-বিজয়কাহিনীই বাঙ্গালীর সাহস ও বীরত্বের একমাত্র নিদর্শন বলিয়া এত দিন গণ্য ছিল। আজ আমরা জানিতে পারিয়াছি যে, বাঙ্গালীর বাহুবল সত্য-সত্যই একদিন তাঁহার গর্বের বিষয় ছিল। বাঙ্গালী শশাঙ্ক কান্যকুব্জ হইতে কলিঙ্গ পৰ্য্যন্ত বিজয়াভিযান করিয়া যে সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, বাঙ্গালী ধর্ম্মপাল ও দেবপাল তাঁহার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করিয়া সূদূর পঞ্চনদ অবধি বাহুবলে বাঙ্গালীর রাজশক্তি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। বাঙ্গালী ধর্ম্মপাল কান্যকুজের রাজসভায় সম্রাটের আসনে বসিতেন, আর সমগ্র আর্য্যাবর্তের রাজন্যবৃন্দ প্রণত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিতেন। গঙ্গাতীরে মৌৰ্য্যসম্রাট অশোকের কীর্তিপূত পাটলিপুত্র নগরীর রাজসভায় ভারতের দূর-দূরান্তর প্রদেশ হইতে আগত সামন্ত রাজন্যবর্গ বহুমূল্য উপঢৌকনসহ নতশিরে দণ্ডায়মান হইয়া পালসম্রাটের প্রতীক্ষা করিতেন। ইহা স্বপ্ন নহে, সত্য ঘটনা। আজ বাঙ্গালী ভীরু দুব্বল বলিয়া খ্যাত, ভারতের সামরিক শক্তিশালী জাতির পংক্তি হইতে বহিষ্কৃত-কিন্তু আমাদের অতীত ইতিহাস মুক্তকণ্ঠে ইহার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতেছে।
মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিতেও বাঙ্গালী বলীয়ান ছিল। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশ হইতে বিতাড়িত বৌদ্ধধর্ম্ম বাঙ্গালীর রাজ্যই শেষ আশ্রয় লাভ করিয়া চারিশত বৎসর টিকিয়াছিল। এই সুদীর্ঘকাল বাঙ্গালী বৌদ্ধজগতের গুরুস্থানীয় ছিল। উত্তরে দুর্গম হিমগিরি পার হইয়া তিব্বতে তাহারা ধর্ম্মের নতুন আলো বিকীর্ণ করিয়াছিল। দক্ষিণে দুর্লঙ্ জলধির পরপারে সুদূর সুবর্ণদ্বীপ পর্য্যন্ত বাঙ্গালী রাজার দীক্ষা গুরুপদে অভিষিক্ত হইয়াছিল। জগদ্বিখ্যাত নালন্দা ও বিক্রমশীল বিহার, বাংলার বাহিরে অবস্থিত হইলেও, চারিশত বৎসর পর্য্যন্ত বাঙ্গালীর রাজশক্তি, মনীষা ও ধর্ম্মভাবের দ্বারাই পরিপুষ্ট হইয়াছিল।
বাণিজ্য-সম্পদে একদিন বাঙ্গালী ঐশ্বৰ্য্যশালী ছিল। তাম্রলিপ্তি হইতে তাঁহার বাণিজ্যপোত সমুদ্র পার হইয়া দূর-দূরান্তরে যাইত। বাংলার সূক্ষ্ম বস্ত্রশিল্প সমুদয় জগতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল।
সংস্কৃত-সাহিত্যেও বাঙ্গালীর দান অকিঞ্চিৎকর নহে। জয়দেবের কোমল কান্ত পদাবলী সংস্কৃত-সাহিত্যের বুকে কৌস্তুভ-মণির ন্যায় চিরকাল বিরাজ করিবে। যত দিন সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের চর্চ্চা থাকিবে তত দিন, গৌড়ী রীতি এবং বল্লালসেন, হলায়ূধ, ভবদেবভট্ট, সর্ব্বানন্দ, চন্দ্রগোমিন, গৌড়পাদ, শ্রীধরভট্ট, চক্রপাণিদত্ত, জীমূতবাহন, অভিনন্দন, সন্ধ্যাকরনন্দী, ধোয়ী, গোবর্দ্ধনাচাৰ্য্য ও উমাপতিধর প্রভৃতির রচনা সমগ্র ভারতে আদৃত হইবে। বাংলার সিদ্ধাচার্যগণের মূল গ্রন্থগুলি যদি কখনো আবিষ্কৃত হয়, তবে বাঙ্গালীর প্রতিভার নূতন এক দিক উদ্ভাসিত হইবে।
শিল্পজগতে মধ্যযুগে বাঙ্গালীর স্থান অতিশয় উচ্চে। ভারতের প্রাচীন শিল্পকলা যখন ধীরে ধীরে লোপ পাইতেছিল, যখন লাবণ্য ও সুষমার পরিবর্তে প্রাণহীন ধৰ্ম্মভাবের ব্যঞ্জনাই শিল্পের আদর্শ হইয়া উঠিয়াছিল, তখন বাঙ্গালী শিল্পীই মূৰ্ত্তিগঠনে ও চিত্রকলায় প্রাচীন চারুশিল্পের কমনীয়তা ও সৌন্দর্য ফুটাইয়া তুলিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। সোমপুরে বাঙ্গালী যে বিহার ও মন্দির নির্মাণ করিয়াছিল, সমগ্র ভারতে তাঁহার তুলনা মিলে না। বাংলার স্থপতিশিল্প ও ভাস্কৰ্য্য সমগ্র পূর্ধ্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করিয়াছে।