গৌড়দেশীয় করণ-কায়স্থগণ সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান ও লিপি-কুশলতার জন্য আৰ্য্যাবর্তের সর্বত্র বিখ্যাত ছিলেন ও প্রাচীন লিপি উৎকীর্ণ করিবার জন্য নিযুক্ত হইতেন। চন্দ্রে, চাহমন ও কলচুরি রাজগণের অনেক লিপি হঁহাদের দ্বারা উৎকীর্ণ হইয়াছে। এতদ্ভিন্ন বিহার ও যুক্তপ্রদেশের কয়েকখানি লিপির লেখকও বাঙ্গালী ছিলেন।
এতক্ষণ আমরা কেবল ধর্ম্মাচাৰ্য, কবি ও পণ্ডিত সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছি। কিন্তু ক্ষত্রিয়োচিত কার্য্যেও অনেক বাঙ্গালী বাংলার বাহিরে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। গদাধর বরেন্দ্রের অন্তর্গত তড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় কৃষ্ণ (৯৩৯-৯৬৮) ও খোট্টিগের অধীনে কার্তিকেয়-তপোবন নামক ভূখণ্ডের অধিপতি হন। মাদ্রাজ-প্রদেশের অন্তর্গত বেলারী জিলার কোলগলুগ্রামে তাঁহার রাজধানী ছিল। তিনি এই স্থানে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করিয়া ব্ৰহ্ম, বিষ্ণু, শিব, পাৰ্ব্বতী, কার্তিক, গণেশ ও সূৰ্য্য প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্ত্তি স্থাপন এবং কুপ-তড়াগাদি খনন করেন। একখানি প্রস্তরলিপিতে তিনি গৌড় চূড়ামণি, বরেন্দ্রীর দ্যোতকারী এবং মুনি ও দুর্ভিক্ষমল্ল (দুর্ভিক্ষের দমনকারী) বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। ১১৯১ অব্দে উত্তীর্ণ একখানি লিপিতে গৌড়বংশীয় রাজা অনেকমল্লের উল্লেখ আছে। তিনি গাঢ়ওয়াল অঞ্চলে রাজত্ব করিতেন এবং কেদারভূমি ও তন্নিকটবর্ত্তী প্রদেশ জয় করেন। সপ্তম শতাব্দীতে শক্তি নামক ভরদ্বাজ-বংশীয় একজন বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ দৰ্বাভিসারের অধিপতি হন। এই স্থান পঞ্জাবের চন্দ্রভাগা ও বিতস্তা নদীর মধ্যস্থলে পার্ব্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। তাঁহার পৌত্র শক্তিস্বামী কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের মন্ত্রী হইয়াছিলেন। বাঙ্গালী লক্ষ্মীধরের পুত্র গদাধর চন্দেল্লরাজগণের মরমর্দির (১১৬৭-১২০২) সান্ধিবিগ্ৰহিক পদ লাভ করিয়াছিলেন। লক্ষ্মীধর নামে আর একজন বাঙ্গালী ও তাঁহার বংশধরগণ সাত পুরুষ যাবৎ চন্দেল্লরাজগণের অধীনে কর্ম্ম করেন। ইহার মধ্যে তিনজন-যশঃপাল, গোকুল ও জগদ্ধর-রাজমন্ত্রীর পদ লাভ করিয়াছিলেন। দেড়শত বৎসরের অধিককাল (আ ১১০০-১২৫০) এই বাঙ্গালী পরিবার চন্দেল্লরাজ্যে উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত থাকিয়া। বাঙ্গালীর শাসনকার্যে দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। পঞ্চম শতাব্দের একখানি লিপি হইতে জানা যায় যে, ‘গৌরী’ দেশের এক ক্ষত্রিয় রাজপুতানার উদয়পুরে একটি রাজ্য স্থাপন করেন। এই গৌর সম্ভবত গৌড় দেশ এবং এই রাজপরিবার সম্ভবত বাঙ্গালী ছিলেন।
চাহমানরাজ তৃতীয় পৃথ্বীরাজের নাম ইতিহাসে সুপরিচিত। মুহম্মদ ঘোরীকে প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করিয়া পরে দ্বিতীয় যুদ্ধে কিরূপে তিনি পরাজিত ও নিহত হন, মুসলমান ঐতিহাসিকগণ তাহা সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু হম্মীর মহাকাব্যে এই যুদ্ধের অন্য রকম বিবরণ পাওয়া যায় এবং এই প্রসঙ্গে উদয়রাজ নামক একজন বাঙ্গালী বীরের কীর্তি উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রিত হইয়াছে। উদয়রাজ পৃথ্বীরাজের সেনাপতি ছিলেন। পৃথ্বীরাজ ঘোরীর সহিত বহু যুদ্ধে জয়লাভ করেন। কিন্তু একবার ঘোরী পৃথ্বীরাজের রাজ্য আক্রমণ করিয়া দিল্লী অধিকার করেন। পৃথ্বীরাজ উদয়রাজকে সসৈন্যে অগ্রসর হইতে আদেশ করিয়া নিজে অল্প সৈন্য লইয়া শত্রুর সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হন এবং পরাজিত ও বন্দী হন। উদয়রাজ সসৈন্যে উপস্থিত হইলে, ঘোরী তাঁহার সহিত যুদ্ধ না করিয়া বন্দী পৃথ্বীরাজসহ দিল্লীর দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। গৌড়বীর প্রভুর পরাজয়েও হতাশ না হইয়া দিল্লী আক্রমণ করেন এবং এক মাসকাল যুদ্ধ করেন। ঘোরীর অমাত্যগণ উদয়রাজের পরাক্রমে ভীত হইয়া শান্তি স্থাপনের নিমিত্ত পৃথ্বীরাজকে মুক্তি দিবার পরামর্শ দিলেন। ঘোরী তাহা না শুনিয়া পৃথ্বীরাজকে বধ করিলেন। প্রভুর মৃত্যুসংবাদ শুনিয়া উদয়রাজ দিল্লী অধিকার করিবার জন্য প্রাণপণে শেষ চেষ্টা করিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। হম্মীর-মহাকাব্যের এই কাহিনী কত দূর বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন, কিন্তু উদয়রাজের বীরত্বকাহিনী একেবারে নিছক কল্পনা, এরূপ অনুমান করাও সঙ্গত নহে। হিন্দু যুগের অবসানে একজন গৌড়ীয় বীর সুদূর পশ্চিমে তুরষ্কসেনার সহিত সংগ্রামে আত্মবিসৰ্জন করিয়া প্রভুভক্তির চরম প্রমাণ দিয়াছিল, বিদেশীয় কবির এই কল্পনাও বাঙ্গালীর পক্ষে কম শ্লাঘার বিষয় নহে।
বাংলার বাহিরে বাঙ্গালী কিরূপ খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করিয়াছিল, তাঁহার যে কয়েকটি মাত্র দৃষ্টান্ত আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জানিতে পারিয়াছি, তাহাই লিপিবদ্ধ হইল। কালসমুদ্রে এইরূপ আর কত বিষ্মকর কাহিনী ও কীর্তিগাথা বিলীন হইয়াছে কে বলিতে পারে? পঞ্জাবের পার্ব্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত সুকেত, কেওস্থল, কাষ্টওয়ার ও মণ্ডী এই কয়টি রাজ্যের রাজগণ বাংলার গৌড়-রাজবংশ-সদ্ভূত, এইরূপ একটি বদ্ধমূল সংস্কার দীর্ঘকাল যাবৎ ঐ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। কাষ্টওয়ার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কাহনপাল সম্বন্ধে প্রচলিত জনশ্রুতি এই যে, তিনি গৌড়ের রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং কতিপয় অনুচরসহ উক্ত পার্ব্বত্য অঞ্চলে গমন করিয়া একটি রাজ্য স্থাপন করেন। পালবংশীয় সম্রাটগণ এই প্রদেশে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন, এবং পরবর্ত্তীকালে তাঁদের অথবা সেনরাজগণের বংশের কেহ এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকিতে পারেন। সুতরাং পূর্ব্বোক্ত জনশ্রুতি একেবারে অমূলক বা অসম্ভব বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। তবে বিশ্বস্ত প্রমাণ না পাইলে, ইহা ঐতিহাসিক সত্য বলিয়াও গ্রহণ করা যায় না।
২২. বাংলার ইতিহাস ও বাঙ্গালীজাতি
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ – বাংলার ইতিহাস ও বাঙ্গালীজাতি