দীপঙ্করের আর একজন অধ্যাপক জ্ঞানশ্রীও বাঙ্গালী ছিলেন। তিনি বিক্রমশীল মহাবিহারের দ্বারপণ্ডিত ছিলেন। কাশ্মীরে জ্ঞানশ্রীদ্র নামে এক বৌদ্ধ আচার্য্যের খ্যাতি আছে, তিনি ও এই জ্ঞানশ্রী সম্ভবত একই ব্যক্তি। তিনি বহু গ্রন্থ লিখিয়াছেন এবং তিব্বতীয় ভাষায় ইহার অনেকগুলির অনুবাদ হইয়াছিল।
বৌদ্ধ আচাৰ্য ব্যতীত বাংলার অনেক শৈব গুরুও বাংলার বাহিরে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। দক্ষিণরাঢ়া নিবাসী উমাপতিদেব (অপর নাম জ্ঞানশিব দেব) চোলদেশে বসবাস করেন এবং স্বামিদেবর এই নামে পরিচিত হইয়া রাজা-প্রজা উভয়েরই শ্রদ্ধা ও সম্মানভাজন হন। এই সময়ে চোলরাজ দ্বিতীয় রাজাধিরাজের (১১৬৩-১১৯০) একজন সামন্তরাজা সিংহলদেশীয় সৈন্যের আক্রমণে ভীত হইয়া উমাপতিদেবের শরণাপন্ন হন। উমাপতিদেব ২৮ দিন শিবের আরাধনা করেন এবং তাঁহার ফলে সিংহলীয় সৈন্য চোলরাজ্য ত্যাগ করিয়া পলাইয়া যায়। কৃতজ্ঞ সামন্তরাজা উমাপতিদেবকে একখানি গ্রাম দান করেন এবং উমাপতি ইহার রাজস্ব তাঁহার আত্মীয়দের মধ্যে ভাগ করিয়া দেন।
জব্বলপুরের নিকটবর্ত্তী প্রাচীন ডাহলমণ্ডলে গোলকীমঠ নামে এক বিখ্যাতি শৈব প্রতিষ্ঠান ছিল। কলচুরিরাজ প্রথম যুবরাজ (আ ৯২৫ অব্দ) এই মঠের অধ্যক্ষকে তিন লক্ষ গ্রাম দান করেন। ইহার আয় হইতে মঠের ব্যয় নির্বাহ হইত। বাঙ্গালী বিশ্বেশ্বরশম্ভু ত্রয়োদশ শতাব্দের মধ্যভাগে এই মঠের অধ্যক্ষপদ লাভ করেন। দক্ষিণ রাঢ়ার অন্তর্গত পূৰ্ব্বগ্রামে তাঁহার জন্ম হয়। বেদে অগাধ পাণ্ডিত্যহেতু তিনি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। চোল ও মালবরাজ তাঁহার শিষ্য ছিলেন এবং কাকতীয়রাজ গণপতি ও ত্রিপুরীর কলচুরিরাজ তাঁহার নিকট দীক্ষাগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি মন্ত্রশিষ্য রাজা গণপতির রাজ্যে বাস করিতেন। গণপতি এবং তাঁহার কন্যা ও উত্তরাধিকারিণী রুদ্রাম্বা তাঁহাকে দুইখানি গ্রাম দান করেন। বিশ্বেশ্বরশম্ভু এই দুইখানি গ্রাম একত্র করিয়া বিশ্বেশ্বর-গোলকী নামে অভিহিত করেন এবং তথায় মন্দির, মঠ, বিদ্যালয়, অন্নছত্র, মাতৃশালা ও আরোগ্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এই গ্রামে ৬০টি দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ-পরিবার বসতি করান এবং তাঁহাদের ভরণপোষণের জন্য উপযুক্ত ভূমিদান করেন। অবশিষ্ট ভূমি তিনভাগে বিভক্ত করা হয়। একভাগ শিবমন্দির, আর একভাগ বিদ্যালয় ও শৈবমঠ, এবং তৃতীয় ভাগ অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যয়-নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট হয়। বিদ্যালয়ের জন্য আটজন অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনজন ঋক, যজু ও সাম এই তিন বেদ পড়াইতেন, আর বাকি পাঁচজন সাহিত্য, ন্যায় ও আগম শাস্ত্রের অধ্যাপনা করিতেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলির জন্যও যথোচিত কর্ম্মচারী ও সেবক প্রভৃতি নিযুক্ত হয়। গ্রামের লোকের জন্য একঘর করিয়া স্বর্ণকার, কৰ্ম্মকার, শিলাকার, সূত্রধর, কুম্ভকার, স্থপতি, নাপিত প্রভৃতি স্থাপিত করা হয়। বিশ্বেশ্বরশঙ্কু জন্মভূতি পূৰ্ব্বগ্রাম হইতে কয়েকজন ব্রাহ্মণ আনাইয়া গ্রামের আয়-ব্যয় পরীক্ষা ও হিসাবরক্ষকের কাৰ্য্যে নিযুক্ত করেন। গ্রামের বিবিধ প্রতিষ্ঠানগুলি যাহাতে ভবিষ্যতে উপযুক্তরূপে পরিচালিত হয়, তাঁহার জন্য তিনি অনেক বিধিব্যবস্থা করেন। বিশ্বেশ্বরশম্ভু আরও বহু সৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করেন এবং বিভিন্ন স্থানে মঠ, মন্দির ও শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করিয়া তাঁহার ব্যয় নির্বাহের জন্য উপযুক্ত জমি দান করেন। বিশ্বেশ্বর নামে তিনি একটি নগরী স্থাপন করেন। শিলালিপিতে এই সমুদয়ের যে সবিস্তার উল্লেখ আছে, তাহা পাঠ করিলে প্রাচীন যুগের বাঙ্গালীর জীবনযাত্রা, সমাজের প্রতি কর্তব্য এবং ধর্ম্মসংস্কার প্রভৃতির আদর্শ আমাদের নিকট উজ্জ্বল হইয়া ওঠে।
বাঙ্গালী বৎস-ভার্গব গোত্রীয় ব্রাহ্মণ বসাবণ হরিয়াণ (পঞ্জাবের হিসার জিলার অন্তর্গত হরিয়ান) প্রদেশের সিংহপল্লী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র ঈশানশিব সংসার ত্যাগ করিয়া বোদামযুতের (যুক্ত প্রদেশের বাউন) শৈব-মঠে বাস করেন। কালক্রমে তিনি এই মঠের অধ্যক্ষ হন এবং একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। গৌড়দেশীয় অবিঘ্নাকর কৃষ্ণগিরি পাহাড়ে (বম্বের অন্ত গত কাহ্নেরি) ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য একটি গুহা খনন করান। তিনি ৮৫৩ অব্দে একশত দ্রম্ম দান করেন। এই গচ্ছিত অর্থের সুদ হইতে উক্ত গুহা বিহারবাসী ভিক্ষুগণকে বস্ত্র দিবার ব্যবস্থা করা হয়।
কয়েকজন বাঙ্গালী পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের জন্য বাংলার বাহিরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন। শক্তিস্বামী নামে একজন বাঙ্গালী কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্যের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁহার পুত্র কল্যাণস্বামী যাজ্ঞবন্ধ্যের তুল্য বলিয়া কথিত হইয়াছেন। কল্যাণস্বামীর পৌত্র জয়ন্ত একজন কবি ও বাগ্মী ছিলেন এবং বেদ-বেদাঙ্গাদি শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। অনেকে মনে করেন যে, তিনি ও ন্যায়মঞ্জরী-প্রণেতা জয়ন্তভট্ট একই ব্যক্তি। এই জয়ন্তের পুত্র অভিনন্দন কাদম্বরী-কথাসার গ্রন্থ রচনা করেন। ইহাতে বাণভট্ট-প্রণীত কাদম্বরীর সারমর্ম কবিতায় বর্ণিত হইয়াছে। ভট্টকোশল-গ্রাম-নিবাসী বাঙ্গালী লক্ষ্মীধর একজন সুপরিচিত কবি ছিলেন। তিনি মালবে গমন করেন এবং পরমাররাজ ভোজের (১০০০-১০৪৫) সভা অলঙ্কৃত করেন। তিনি চক্রপাণি-বিজয় নামক একখানি কাব্য প্রণয়ন করেন। দক্ষিণ রাঢ়ার অন্তর্গত নবগ্রাম-নিবাসী হলায়ূধও মালবে বাসস্থাপন করেন। তাঁহার রচিত ৬৪টি শ্লোক মান্ধাতা (প্রাচীন মাহিম্মতী?) নগরের এক মন্দিরগাত্রে উত্তীর্ণ হয় (১০৬৩ অব্দ)। মদন নামে আর একজন বিখ্যাত বাঙ্গালী কবি বাল্যকালে মালবে গিয়া তাঁহার কবিত্বশক্তির জন্য বাল-সরস্বতী উপাধি প্রাপ্ত হন এবং পরমাররাজ অর্জুন বর্ম্মার (১২১০-১২১৮) গুরুপদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি পারিজাতমঞ্জরী’ নামক কাব্য রচনা করেন। চন্দ্রেরাজ পরমর্দির সভায় বাঙ্গালী গদাধর ও তাঁহার দুই পুত্র দেবর ও ধৰ্মধর এই তিন কবি বাস করিতেন। রামচন্দ্ৰ কবিভারতী নামে আর একজন বাঙ্গালী সুদূর সিংহলদ্বীপে প্রতিপত্তি লাভ করেন। বীরবতী গ্রামে তাঁহার জন্ম হয় এবং অল্পবয়সেই তিনি তর্ক, ব্যাকরণ, শ্রুতি, স্মৃতি, মহাকাব্য, আগম, অলঙ্কার, ছন্দ, জ্যোতিষ ও নাটক প্রভৃতিতে পারদর্শী হন। রাজা দ্বিতীয় পরাক্রমবাহুর রাজ্যকালে (১২২৫-৬০) তিনি সিংহলে গমন করিয়া বৌদ্ধ আচার্য্য রাহুলের শিষ্যত্ব গ্রহণ ও বৌদ্ধধর্ম্মে দীক্ষা লাভ করেন। রাজা পরাক্রমবাহু তাহাকে ‘বৌদ্ধগমচক্রবর্ত্তী এই সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করেন। রামচন্দ্র ভক্তিশতক, বৃত্তমালা ও বৃত্তরত্নাকর-পঞ্জিকা এই তিনখানি গ্রন্থ রচনা করেন। শেষোক্ত গ্রন্থের রচনাকাল ১২৪৫ অব্দ।