আৰ্য্যগণের উপনিবেশের ফলে আৰ্য্যগণের ভাষা, ধর্ম্ম, সামাজিক প্রথা ও সভ্যতার অন্যান্য অঙ্গ বাংলা দেশে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইল। প্রাচীন অনাৰ্য্যভাষা লুপ্ত হইল, বৈদিক ও পৌরাণিক এবং বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম্ম প্রচারিত হইল, বর্ণাশ্রমের নিয়ম অনুসারে সমাজ গঠিত হইল-এককথায় সভ্যতার দিক দিয়াও বাংলা দেশ আর্য্যাবর্তের অংশরূপে পরিণত হইল। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় যে যখন কোনো প্রবল উন্নত সভ্য জাতি ও দুর্বল অনুন্নত জাতি পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তখন এই শেষোক্ত জাতি নিজের সত্তা হারাইয়া একেবারে প্রথমোক্ত জাতির মধ্যে মিশিয়া যায়। তবে পুরাতন ভাষা, ধর্ম্ম ও আচার-অনুষ্ঠান একেবারে বিলুপ্ত হয় না-নূতনের মধ্য দিয়া পরিবর্তিত আকারে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলা দেশেও এই নীতির অন্যথা হয় নাই। বাংলার প্রাচীন অনাৰ্য্য জাতি সর্বপ্রকারে আৰ্যসমাজে মিশিয়া গিয়াছে। কিন্তু বাঙ্গালীর ‘খোকা-খুকি’ ডাক, বাঙ্গালী মেয়ের শাড়ি-সিন্দুর ও পান-হলুদ ব্যবহার, বাঙ্গালীর কালী-মনসা পূজা ও শিবের গাজন, বাংলার বালাম চাউল প্রভৃতি আজও সেই অনাৰ্য্য যুগের স্মৃতি বহন করিতেছে। ঠিক কোন সময়ে আৰ্য প্রভাব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহা সঠিক নির্ণয় করা যায় না। তবে অনুমান হয় যে খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দে বা তাঁহার পূর্ব্বেই যুদ্ধযাত্রা, বাণিজ্য ও ধর্ম্ম প্রচার প্রভৃতি উপলক্ষে ক্রমশ বহুসংখ্যক আৰ্য্য এদেশে আগমন ও বসবাস করিতে আরম্ভ করেন। গুপ্ত সম্রাটগণ এদেশে রাজ্য স্থাপন করার ফলে যে আৰ্য্য প্রভাব বাংলায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। বঙ্গদেশে গুপ্তযুগের, অর্থাৎ পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দের যে কয়খানি তাম্রশাসন ও শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে বেশ বুঝা যায় যে আৰ্যগণের ধর্ম্ম ও সামাজিক রীতিনীতি এই সময় বাংলায় দৃঢ় প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। ধর্ম্ম ও সমাজ প্রসঙ্গে পরবর্ত্তী কয়েকটি পরিচ্ছেদে এ বিষয়ে আলোচনা করা যাইবে। কিন্তু এই যুগে আর্য্য প্রভাবের আরও যে কয়েকটি পরিচয় পাওয়া যায়, নিম্নে তাহা সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাইতেছে।
উপরোক্ত তাম্রশাসন ও শিলালিপিতে শহর ও গ্রামবাসী বহুসংখ্যক বাঙ্গালীর নাম পাওয়া যায়। এই নামগুলি সাধারণত কেবলমাত্র একটি শব্দে গঠিত-যেমন দুর্লভ, গরুড়, বন্ধুমিত্র, ধৃতিপাল, চিরাতদত্ত প্রভৃতি। এই সমুদয় নামের শেষে চট্ট, বর্ম্মণ, পাল, মিত্র, দত্ত, নন্দী, দাস, ভদ্র, দেব, সেন, ঘোষ, কুণ্ড প্রভৃতি বর্ত্তমানে বাংলায় ব্যবহৃত অনেক পদবী দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু এগুলি তখন যে নামের অংশমাত্র ছিল অথবা বংশানুক্রমিক পদবীরূপে ব্যবহৃত হইত, তাহা নির্ণয় করা কঠিন। কিন্তু মোটের উপর এই নামগুলি যে আৰ্য প্রভাবের পরিচায়ক, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
বাংলার গ্রাম ও নগরীর নামেও যথেষ্ট আৰ্য্য প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়। পুণ্ড্রবর্দ্ধন, কোটিবর্ষ, পঞ্চনগরী, চণ্ডগ্রাম, কৰ্ম্মান্তবাসক, স্বচ্ছন্দপাটক, শীলকুণ্ডু, নব্যাবকাশিকা, পলাশবৃন্দকে প্রভৃতি বিশুদ্ধ আৰ্য্য নাম। অনাৰ্য্য নামকে সংস্কৃতে রূপান্তরিত করা হইয়াছে এরূপ বহু দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়-যথা খাড়াপাড়া, গোষাট পুঞ্জক প্রভৃতি। প্রাচীন অনাৰ্য্য নামেরও অভাব নাই যেমন ডোঙ্গা, কণামোটিকা ইত্যাদি। এই সমুদয় জনপদ-নামের আলোচনা করিলেও স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় যে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে আর্য্য সভ্যতা বাঙ্গালীর সমাজে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।
০৩. প্রাচীন ইতিহাস
তৃতীয় পরিচ্ছেদ –প্রাচীন ইতিহাস
গুপ্তযুগের পূর্ব্বে প্রাচীন বাংলার কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস সঙ্কলন করার উপাদান এখন পর্য্যন্ত আমরা পাই নাই। ভারতীয় ও বিদেশীয় সাহিত্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত উক্তি হইতে আমরা ইহার সম্বন্ধে কিছু কিছু সংবাদ পাই, কিন্তু কেবলমাত্র এইগুলির সাহায্যে সন তারিখ ও ঘটনাসম্বলিত কোনো ইতিহাস রচনা সম্ভবপর নহে।
সিংহলদেশীয় মহাবংশ নামক পালি গ্রন্থে নিম্নলিখিত আখ্যানটি পাওয়া যায়।
বঙ্গদেশের রাজা কলিঙ্গের রাজকন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁহাদের কন্যা মগধ যাইবার পথে লাঢ় (রাঢ়) দেশে এক সিংহ কর্ত্তৃক অপহৃত হন এবং ঐ সিংহের গুহায় তাঁহার সীহবাহু (সিংহবাহু) নামে এক পুত্র ও সীহসীবলী নামে এক কন্যা জন্মে। পুত্রকন্যাসহ তিনি পলাইয়া আসিয়া বঙ্গদেশের সেনাপতিকে বিবাহ করেন। কালক্রমে বঙ্গরাজ্যের মৃত্যু হইলে অপুত্রক রাজার মন্ত্রীগণ সীহবাহুকেই রাজা হইতে অনুরোধ করেন কিন্তু তিনি তাঁহার মাতার স্বামীকে রাজপদে বরণ করিয়া রাঢ়দেশে গমন করেন। এখানে তিনি সীহপুর নামক নগর প্রতিষ্ঠা করিয়া রাজ্য স্থাপন করেন এবং সীহসীবলীকে বিবাহ করেন। তাঁহার বহু পুত্র জন্মে। তাহাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠের নাম ছিল বিজয়।
বিজয় কুসঙ্গীদের সঙ্গে মিশিয়া রাজ্যে নানারকম অত্যাচার করিত। রাজা তাঁহার চরিত্র সংশোধনের চেষ্টা করিলেন কিন্তু কোনো ফল হইল না। অবশেষে বিজয় ও তাঁহার সাত শত সঙ্গীর মাথা অর্ধেক মুড়াইয়া স্ত্রী-পুত্রসহ এক জাহাজে চড়াইয়া তিনি তাহাদিগকে সমুদ্রে ভাসাইয়া দিলেন। তাহারা লঙ্কাদ্বীপে পৌঁছিল।