ধ্রুবকে সেজন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে প্রীতি আর টিপুকে নিয়ে। নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারছি না, বিশেষ করে প্রীতিকে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তাই বর নিজেকে অপমানিত লেগেছে।
অফিসে এসে পরের দিনই বললে। বাবার অসুখ নিয়েই শুরু করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই দরজায় তালা দেওয়া।
অবিনাশ হাসতে হাসতে বললে, এই তো সবে শুরু। সেদিন বলছিলে না, তোমাদের রাস্তায় একটা ফ্ল্যাট খালি হয়েছিল…
ধ্রুবর মনে পড়ে গেল। অবাক হয়ে বললে, তার সঙ্গে এর কি সম্পর্ক?
–সম্পর্ক আছে ব্রাদার, আছে। কলকাতায় কোথাও এখন ফ্ল্যাট খালি হয় না। কারণ, আইন ভাড়াটেদের পক্ষে। তবু ফ্ল্যাট খালি হয় কেন?
ধ্রুব বেশ কিছুদিন আগে বাজারে যাওয়ার সময় দেখেছে ওদের বাড়ির তিন-চারখানা বাড়ির পরেই একটা লরিতে মালপত্র বোঝাই হচ্ছে। ফ্রীজ, আলমারি, খাট, আরো কত কি। ঠিক একদিন ধ্রুব এ বাড়িতে যেভাবে এসেছিল।
রাস্তার একজনকে জিগ্যেস করে জানল, তিনতলার ভদ্রলোক চলে যাচ্ছেন।
কেন চলে যাচ্ছেন জিগ্যেস করার কৌতূহল হয়নি। ফ্ল্যাট খালি হচ্ছে এটাই বড় খবর। এসেই প্রীতিকে বলেছিল।
সঙ্গে সঙ্গে প্রীতি বলেছে, একবার গিয়ে খবর নিয়ে দেখো না, কেমন ফ্ল্যাট। কত ভাড়া।
অর্থাৎ ছোটমাসিদের জন্যে। ওদের কথা ধ্রুবরও মনে পড়েছিল। মন্দ কি, একই পাড়ায় যদি আত্মীয়স্বজন কেউ থাকে সে তো ভালই।
বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করেছে পরের দিনই।
গিয়ে শুনেছে, ভাড়া হয়ে গেছে। পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বলেছেন, বিশ্বাস করবেন না, এই ছোট ছোট তিনখানা ঘর, এক হাজার টাকা ভাড়া। সিন্ধি ব্যবসাদার, অ্যাডভান্স যে কত নিয়েছে কে জানে।
রাখালবাবুও সে খবর পেয়েছেন। পেয়েই ধ্রুবর নীচের ফ্ল্যাটের বঙ্কিমবাবুকে শুনিয়েছেন।
দুটো বছর ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে, কিন্তু ধ্রুবর তো মনে হয় এই সেদিন। এরই মধ্যে ফ্ল্যাটের ভাড়া যে এমন আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে কল্পনাও করেনি।
রাখালবাবুর হয়তো সেজন্যেই অনুশোচনা। তখন এমন বাজার ছিল না, তখনও দুচারটে ফ্ল্যাট খোঁজাখুঁজি করলে পাওয়া যেত।
অবিনাশ বললে, সিন্দুক নয় হে, সিন্দুক নয়। আসলে এখন তোমার বাড়িওয়ালা পস্তাচ্ছেন, ভাবছেন কি ভুলই করে ফেলেছি।
তারপর হেসে বলেছে, স্টেপ বাই স্টেপ, দেখে নিও। এ তো সবে শুরু। কপোরেশনের ট্যাক্স বেড়েছে, বলবে ভাড়া বাড়াতে হবে। ইলেকট্রিকের চার্জ বেড়েছে, ভাড়া বাড়াও। তারপর মোক্ষম দাওয়াই, জলযুদ্ধ।
—মানে? ধ্রুব বুঝতে পারেনি।
হো হো করে হেসে উঠেছে অবিনাশ।—তাও জানো না? আমিও ভুক্তভোগী হে, এখন জলপথে যুদ্ধ চলছে।
সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলেছে, নাও একটা ধরাও। হার্টকে তাজা করে নাও।
তারপর।-স্টেপ বাই স্টেপ, মিলিয়ে নিও। ভাড়া বাড়ালেও যা, না বাড়ালেও তাই। তিনবারের জায়গায় দুবার পাম্প চালাবে। কতক্ষণ চালায়? আধ ঘণ্টা হলে বিশ মিনিট, তারপর পনেরো কি দশ। তুমি চটবে। চ্যাঁচাবে, গালাগালি দেবে। দুদিন পাম্প চালাবে ঠিকমত, কিন্তু ছাদে বসে বাড়িওয়ালা কলকাঠি নাড়বে। ট্যাঙ্কের চাবি আছে জানো? সেটা তিন প্যাঁচ মাত্র খোলা রাখবে। চুরচুর চুরচুর করে জল পড়বে কলের মুখ দিয়ে, বালতি ভরবে না।
সিগারেটে দুটো বড় বড় টান দিয়ে অবিনাশ পাশের টেবিলের সুনন্দকে ডাকল।–এই যে বাড়িওয়ালা শুনে যাও।
সুনন্দ হাসল। তারপর সামনে উঠে এসে বললে, সব শুনছি, কিন্তু আমার ভাড়াটেদের তো দেখেননি। গুণ্ডা, দাদা, সব গুণ্ডা। গালাগালির ভাষা যদি শোনেন…
অবিনাশ বললে, ওদের মতো হতে পারলে তবেই ভাই টেকা যায়। আইন আদালত নিয়ে কি আর জলপথে যুদ্ধ করা যায় তোমাদের সঙ্গে।
তারপরই ধ্রুবকে প্রশ্ন করল, ভাড়াটেরা যে এখনও টিকে আছে কেউ কেউ, এই আমার মতো, কেন বলো তো? কারা টিকিয়ে রেখেছে?
ধ্রুব হেসে বললে, জানি না।
—ভারী! ভারী কাকে বলে জানো? ওই যে বাঁকের দুপাশে দুটো কেরোসিনের টিন বাঁধা? রাস্তার টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌছে দেয়। ওরা। সব রাস্তায় দেখতে পাবে।
হাসতে হাসতে বললে, পুরমন্ত্রীমশাই মাঝে মাঝে বিবৃতি দেন দেখেছ? জল সাপ্লাই বাড়িয়ে দিচ্ছি। জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করে, কাকে সাপ্লাই দিচ্ছ? সে তো বাড়িওয়ালাকে। আমাদের সাপ্লাই তো ওই ভারী, তাও কল নয়, টিউবওয়েল থেকে। সকাল থেকে দেখবে, লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঝগড়া মারামারি। কি? না, ওবাড়ির তিনতলায় এবাড়ির দোতলায় জল সাপ্লাই দিতে হবে। রীতিমত একটা প্রফেশন তৈরি হয়ে গেছে যে, এই বাড়িওয়ালাদের কল্যাণে।
স্টেপ বাই স্টেপ। অবিনাশ বলেছিল।
ঠিক তাই। ধ্রুব একবার পঞ্চাশটা টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল, রাখালবাবু সন্তুষ্ট হবেন।
বঙ্কিমবাবু রাজি হননি। বলেছিলেন, জলে দিচ্ছেন টাকাটা।
অমিতবাবু প্রথমে খুব হম্বিতম্বি করেছিলেন। গালাগালিও। আইন আছে বলে শাসিয়েছিলেন। তারপর বুঝে গেলেন আইন ওই খাতাকলমেই।
শেষ পর্যন্ত চার-চারটে ফ্ল্যাটেই ভারী এসে ঢুকল। সুযোগ বুঝে তারাও রেট বাড়িয়ে দিল। এক ভার জল ষাট থেকে লাফিয়ে এক টাকা। তার আবার দুদিন আসে না, দর বাড়ায়। কোনওদিন টিউবয়েলটাই খারাপ। গরমের দিনে মাথা গরম হয়ে যায়। বঙ্কিমবাবু একদিন বাড়িওয়ালার ওপর এমন রেগে গিয়েছিলেন, বাড়িওয়ালাকে হয়তো খুনই করে বসতেন।