সত্যিই বুঝত না ধ্রুব। কোনওদিন তো খোঁজ করতে হয়নি। হয়তো দুচারজনের কাছে শুনেছে, কিন্তু মনে দাগ কাটেনি।
অথচ এখন আর উপায় নেই। বলে ফেলেছে, চলে যাব। আর মা এসে একটুও কান্নাকাটি করেননি। বাবাও বলেছেন, যেতে চাস, যা। এখন আর উপায় নেই। মানমর্যাদার প্রশ্ন।
মেজবৌদি একদিন বললে, চলে যাবার আগে আমাকে অন্তত জানিয়ো ধ্রুবদা, দুম করে চলে যেও না।
অর্থাৎ সকলেই ধরে নিয়েছে ওরা চলে যাবে।
তখন ধ্রুবর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান একটা ভাড়ার ফ্ল্যাট। যার সঙ্গেই দেখা হয়, কথায় কথায় জানিয়ে রাখে। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে চোখ বুলিয়ে যায়। দালাল ধরে।
প্রীতি বলেছিল, তিনখানা ঘর না হলে চলে না। একখানা শশাবার ঘর, একটা বসার : আর টিপু তো বড় হচ্ছে, ওর জন্যে একটা। ও তো বড় হচ্ছে, শশায়ার আর পড়ার জন্যে ওই একটা বাড়তি ঘর দরকার।
প্রীতি ওর দাদাকেও বললে একটু খোঁজ রাখতে।
সে সব শুনে বললে, তিনখানা ঘর? সে তো চার পাঁচশো টাকা ভাড়া হবে। তাছাড়া এদিকে কোথায় আর পাবি। অনেক দূরে যেতে হবে।
প্রীতি বললে, চার পাঁচশোই দেব।
–দিবি? তা হলেখাবি কি? পাঁচশো টাকা যদি ভাড়াতেই চলে যায়!
ধ্রুব সে-কথাও ভেবেছিল। একটু ভয় ভয় করত। যদি চালাতে না পারি!
তখন অবশ্য এমন বাজার ছিল না। আর চার পাঁচশো টাকাতেও ফ্ল্যাট পাওয়া যেত।
কিন্তু হন্যে হয়ে খুঁজে খুঁজে ধ্রুব তখন হয়রান হয়ে গেছে। কোথাও আর মনের মতো ফ্ল্যাট মিলছে না। যদি বা পাওয়া যায় তাদের আবার ভাড়াটেকেই পছন্দ হয় না। বিনোদবাবুর কথাগুলো তখনই মনে পড়েছিল। পুরোনো ভাড়াটেদের ওপর কেন তাঁর এত রাগ বুঝতে পেরেছিল।
একদিন বলেছিলেন, আইনটাইন বদলানো উচিত। একশো দেড়শো টাকায় একটা পেল্লায় বাড়ি নিয়ে থাকবে কেন মশাই? আর আমি তো চারশো দিতে চাই, কোথাও পাচ্ছি না।
শুনে বিছুটির জ্বালা ধরত। যেন বিনোদবাবু ওদের হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িটা সম্পর্কেই বলছেন।
ভাড়ার ফ্ল্যাট খুঁজতে খুঁজতে ধ্রুবও তখন বিনোদবাবুর দলে। ক্রমশই যেন হতাশ হয়ে পড়ছিল।
বাড়িতেও তখন সবসময় থমথমে ভাব। কোথাও কোনও হাসিহল্লা নেই, রেডিও চলে, চললেও চাপা গলায়, রেকর্ডে গান শোনা যায় না। যেন বাড়িতে কোনও মুমূর্ষু রোগী আছে।
প্রতি হেসে বলেছিল, এরই নাম কোল্ডওয়ার।
ধ্রুবর তখন একটাই কাজ। সকালে উঠেই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখা। ঠিকানা থাকলে সটান সেখানেই চলে যাওয়া। বেশির ভাগই বক্স নম্বর। অতএব বসে বসে চিঠি লেখো। তারপর ব্রোকারের অফিসে তাগাদা দিতে যায়। রাস্তার মোড়ে কিংবা চায়ের দোকানের সামনে কোথাও কোথাও জনাকয়েক উটকো দালাল জটলা করে। তাদের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে, কিছু খবর পেলেন? বেশ তোষামোদের গলায় বলতে হয়। যেন তারা ইচ্ছে করলেই একটা ভাল ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিতে পারে। কামধেনুর মতো তারা তিনচারটে দারুণ ভাল ভাল ফ্ল্যাটের খবর বলে। ধ্রুব উৎসাহ দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাড়ার অঙ্কটা শুনতে হয়। শুনেই থমকে যেতে হয়। কিংবা অন্য কোনও শর্ত।
কেউ কেউ ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে যায়। বাড়িটায় ঢোকার আগেই ফ্ল্যাট অপছন্দ, তবু দালালকে খুশি রাখার জন্যে চারতলায় উঠতে হয়, জানলা দরজা খুলে ঘর দেখতে হয়।
তারপর অন্য কোনও কারণ দেখিয়ে বলতে হয় না এটা চলবে না।
দালাল হাত পাতে, হেসে বলে, ঘোরাঘুরি তো করছি, দেখি…
পাঁচ, দশ, বিশ টাকা দেয় ধ্রুব। জানে, এদের অনেকের এই টাকাটাই রোজগার।
কোথাও পাড়াটা খারাপ, কোথাও বাড়িটা পুরনো, জানালা দরজা ভাঙা। কোথাও বাথরুম কিংবা রান্নাঘরই সমস্যা। অথবা আলোবাতাস নেই।
ধ্রুব বেশ বুঝতে পারে, যে বাড়িটা ছেড়ে আসছে, ও সেই রকম একটা ফ্ল্যাট খুঁজছে। যে পাড়া ছেড়ে আসছে, সেই রকম পাড়া খুঁজছে।
দেখতে দেখতে দুটো মাস পার হয়ে গেল। প্রীতি অনুযোগেব স্বরে বললে, তোমার এখান থেকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই সেকথাটা ফ্র্যাঙ্কলি বললেই তো পার।
ধ্রুব অবাক হয়ে তাকাল প্রীতির মুখের দিকে। কোনও কথা বলল না। একটা অক্ষমতা, একটা অসহায়তার মধ্যেই ও তখন নিপীড়িত। প্রীতির কথায় ও লোধহয় রীতিমত ধাক্কা খেল।
বাড়ির পরিবেশও এদিকে অসহ্য হয়ে উঠেছে।
ঠিক সেই সময়েই একটা ঘটনা ঘটে গেল। অভাবিত।
ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়ার জন্যে প্রায়ই লেট হয়ে যেত অফিসে। কোনও কোনওদিন অবশ্য প্রীতি একাই চলে যেত। টিপুকে সঙ্গে নিয়ে। তারপর এক সময় বিষণ্ণ মুখ নিয়ে ফিরে আসত।
সেদিনও বিকেলে একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা। টেলিফোনে আফসেই খবর পেল। তাই একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরল।
ফিরেই দাদার মেয়ে সিমলির কাছে শুনল, ছোটকাকিমা বেরিয়ে গেছে।
—কোথায় গেছে বলে গেছে?
সিমলি ঠোঁট ওল্টালো।—কি জানি।
এটাই এখন এ বাড়ির রীতি। যেটুকু খবর বলেছে সেটুকুই যেন বাড়তি। বড় অভিমান হয়, বুকে লাগে। বিয়ের আগে দাদা বৌদিরা কত আপন ছিল। এই সিমলিকে ধ্রুব তত কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। অথচ এখন সিমলিও যেন কেমন পর-পর। হয়তো মা বাবার কথা শুনে শুনে দূরে সরে যাচ্ছে।
ঠোঁট উল্টে কি জানি। যেন জানার প্রয়োজনই নেই। দোষ শুধু সিমলির নয়। প্রীতিও ওদের কোনও কথা জানিয়ে যায় না। ধ্রুবকেও তখনই বেরোতে হবে, তা না হলে বাড়িওয়ালা থাকবে না। এদিকে সন্ধেও হয়ে আসছে। ও ভেবেছিল, প্রীতিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ভাবল, একাই চলে যাই।
বেরোতে যাচ্ছে, মেজবৌদি বললে, প্রীতি তো, সেই গুণ্ডামতো দালালটা এসেছিল একদিন, একটা হাত কাটা, তার সঙ্গে কি সব কথা বলছিল, হঠাৎ বেরিয়ে গেল তার সঙ্গে।