জে পারছি।
কারো উপরে কোন দাবি দাওয়া রাখবো না। দাবী দাওয়া তুইল্যা নাও।
জ্বে-আচ্ছা।
বললে তো হবে না। বল কারো উপরে কোন দাবী দাওয়া নাই।
কারো উপরে কোন দাবী-দাওয়া নাই।
মৌলানা সাহেব থাকেন মসজিদে। মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে তাঁকে মসজিদের পাশেই একটা ঘর তুলে দেয়ার কথা। এখনো তোলা হয়নি। সবই অবশ্যই নির্ভর করছে বদরুল আলম সাহেবের উপর। তিনি একবার হা বললেই হয়। মৌলানা সাহেব মসজিদে যাবার আগে বদরুল আলম সাহেবের সংগে দেখা করে গেলেন। বদরুল আলম সাহেব বললেন, তওবা ঠিক ঠাক হয়েছে?
জ্বি
অবস্থা কি দেখলেন?
সময় ঘনায়ে আসছে। তওবার পরে তিন দিনের বেশী টিকে না। তবে এ তাও ঠিকবে না।
হয়েছে কি?
জানি না। শরীর পচে যাচ্ছে এইত দেখি। গন্ধে থাকা মুশকিল।
এদিকে সাতাশ রোজায় মেয়ে, মেয়ে-জামাই আসতেছে।
মৌলানা দৃঢ় স্বরে বলল, এ এক দুই দিনের বেশী নাই।
তওবা পড়ানোর চতুর্থ দিনেও দেখা গেল ইউনুস বেঁচে গেছে। প্রশ্ন করলে চিচি করে জবাব দেয়। তবে অবস্থা যে খুব খারাপ তা বোঝা যায়। আগে শরীরের পচা দুর্গন্ধ বাংলা ঘরের আশে পাশেই সীমাবন্ধ ছিল এখন তা ভেতর বাড়ি পর্যন্ত গেছে।
সেনিটারী ইন্সপেক্টরের পরামর্শে ঘরের চারদিকে প্রচুর ফিনাইল দিয়েছেন, তাতেও গন্ধ যাচ্ছে না। তাছাড়া বাংলা ঘরের চারপাশে এখন শিয়াল ঘুরাফিরা করে। মানুষ পচা গন্ধের আর্কষণ এড়াতে পারে না।
বদরুল আলম সাহেব নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দেখতে গেলেন, কি রে অবস্থা কি?
জ্বে ভাল।
ভাল হলেই ভাল।
রাইতে বড় ভয় লাগে।
ভয় লাগে কেন?
কি যেন চাইরপাশে ঘুরাফিরা করে। চউক্ষে দেখি না, খালি কথা শুনি।
মৌলানা সাহেব এসব শুনে বললেন, সময় ঘনায়ে আসছে। আজরাইল চাইরপাশে ঘুরাফিরা করে।
মৌলানার উপর বিরক্তিতে বদরুল আলম সাহেবের গা জ্বলে যায়। কি সব কথা, আজরাইল ঘুরাফিরা করে। ব্যাটা তওবাটা ঠিকমত পড়িয়েছে কি-না কে জানে।
মৌলানা সাহেব?
জ্বি।
তওবা কি টিকঠাক পরানো হয়েছে?
জ্বি তা হইছে।
দেখেন আরেকবার পড়াবেন কি-না। কষ্ট পাচ্ছে এই জন্যে বলতেছি, অন্য কিছু না।
আইজ আরেকবার পড়ায়ে দিব। কোন অসুবিধা নাই। তওবা দিনের মধ্যে দুইবারও পড়ানো যায়। কোন অসুবিধা নাই। এই প্রসংগে রসুলাল্লাহর একটা হাদিস আছে। পেয়ারা নবী বলেছেন ..
আচ্ছা থাক। আরেকদিন শুনব।
মৌলানা সাহেব বললেন, অনেক সময় মনের মধ্যে কোন আফসোস থাকলে জ’ব বাইর হইতে চায় না। জিজ্ঞেস কইরা দেখা দরকার কিছু খাইতে চায় কি না। কাউরে দেখতে চায় কিনা।
আচ্ছা এটা খোঁজ নিব।
দ্বিতীয়বার তওবার কথা শুনে ইউনুস বেশ অবাক হল। চি-চি করে বলল, একবার তো করছি। তওবার পরে কোন পাপ কাজ করি নাই।
মৌলানা সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, নাফরমানী কথা বলবা না। পাপ কাজ করছ কি কর নাই তার বিচার তোমার উপরে না, আল্লাহ পাকের উপরে।
আবার তওবা পড়ানো হল। বদরুল আলম সাহেব তওবা পড়ানোর শেষে খোঁজ নিতে এলেন, কিরে শইল কেমন?
জ্বে ভাল।
কিছু খাইতে মনে চায়?
জ্বে না।
মনে চাইলে বল।
তেঁতুলের পানি দিয়া ভাত খাইতে মনে চায়।
তাকে তেঁতুলের পানি দিয়ে ভাত খেতে দেয়া হল। ভাত খাওয়া শেষ হবার সংগে সংগেই শ্বাসকষ্ট শুরু হল। বুক হাঁপরের মত উঠা-নামা করছে। চোখ মনে হয় বের হয়ে আসছে। বদরুল আলম সাহেব মৌলানাকে খবর দিয়ে রাখলেন। ভালমন্দ কিছু হলে দিনের মধ্যেই দাফন কাফন শেষ করতে হবে।
দিনে কিছুই হল না। রাতে শ্বাসকষ্ট মনে হল খানিকটা কমে এসেছে।
মৌলানা সাহেব ঘুমুতে গেলেন। যাবার আগে বদরুল আলম সাহেবকে বলে গেলেন, আরো একটা দিন দেখতে হবে।
বদরুল আলম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, আর একদিন পরে কি?
অমাবশ্যা লাগতেছে। অমাবশ্যার টান সহ্য হবে না।
বদরুল আলম সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, একদিকে বলেন আজরাইলের কথা, আরেকদিকে বলেন অমাবশ্যার কথা। আজরাইল কি পূর্ণিমা অমাবশ্যা দেখে ঘুরাফিরা করে?
অমাবশ্যার রাতে ইউনুসের অবস্থা খুবই খারাপ হল। বুকের ভেতর থেকে গোঁ গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে। মুখে ফেনা ভাঙছে। রাত যে কাটবে না, তা বোঝাই যাচ্ছে। বদরুল আলম সাহেবের স্ত্রীও শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে এক সময় ইউনুসকে দেখে গেলেন। খাবার প্লেটে পড়ে আছে। ইউনুস ছুঁয়েও দেখেনি। তিনি বললেন, এর মুখে তোমরা পানি দাও, দেখছ না ঠোট চাটতেছে। আহারে।
ভোরবেলা বদরুল আলম সাহেব খোজ নিতে গেলেন।
কী রে অবস্থা কী?
ইউনুস চিঁ চিঁ করে বলল, জে ভাল।
শ্বাসকষ্ট নাই? জ্বে না।
বদরুল আলম সাহেবের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ইউনুস বলল, রাইতে একটা শিয়াল ঢুকছিল। পাও হাতে কামড় দিছে। আইজ আপনে বইল্যা দিবেন হাতের কাছে যেন একটা লাঠি দেয়। আর একটা হারিকেন।
বদরুল আলম সাহেব কিছুই বললেন না। তার মেজাজ রোজার সময় এমনিতেই চড়া থাকে। আজ সেই মেজাজ আকাশে চড়ে গেল।
তিনি ইফতারির সময় মজনুকে বলে দিলেন, ইউনুসের হাতের কাছে যেন একটা লাঠি দেয়া হয়। আর একটি হারিকেন। মজনু এ বাড়ির কামলা। তার উপর দায়িত্ব ইউনুসকে খাবার দাবার দিয়ে আসা। এই কাজটা তার খুবই না-পছন্দ, কারণ ইউনুস এখন আর নিজে নিজে খেতে পারে না। খাবার মুখে তুলে দিতে হয়। ঘেন্নায় মজনুর বমি আসার উপক্রম হয়।
মজনু বলল, ইউনুস হারামজাদা বিরাট বজ্জাত।
বদরুল আলম সাহেব তাকালেন। কেন বজ্জাত সেটা শুনতে চান।
মজনু বলল, মৌলানা সাব যে দুই-দুইবার তওবা করাইলেন, কোনবারই এই হারামজাদা তওবা করে নাই। মৌলানা সাব তারে যে কথা বলছেন, হে মনে মনে উল্টা কথা বলেছে।