আর গাধাগুলি তাকে নিয়ে এসে তাঁর বাংলা ঘরে শুইয়ে দিয়েছে। কী যন্ত্রণা। এটা কি তার বাড়ি ঘর? গাধাগুলির সাহস দেখে তিনি স্তম্ভিত। বাংলা ঘর দশ কাজে ব্যবহার হয়। লোকজন আসে। সেখানে আধা পচা মানুষ এনে শুইয়ে দিল। বিকট গন্ধে বাংলা ঘরের ত্রিসীমানায় এখন কেউ যেতে পারে না। নাড়িভূঁড়ি উল্টে আসে।
তিনি আরো উঁচু গলায় ডাকলেন–এ্যাই, এ্যাই।
কোন জবাব পাওয়া গেল না। তিনি কিছুক্ষণ কান পেতে রইলেন। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও আসছে না। নড়াচড়ার শব্দও নেই। মারা গেছে বোধ হয়। আশ্চর্য এই বাড়ির লোকজনের কাণ্ডজ্ঞান। এখন মরে তখন মরে একটা মানুষ, তার ঘরে সন্ধাবেলা বাতি দেয় নি। অথচ তিনি নিজে জায়নামাজে দাঁড়াবার আগে বলেছেন। যেন বাতি দেয়া হয়। কতক্ষণ আগে মরেছে কে জানে। অন্ধকার ঘর, কে জানে শিয়াল কুকুরে টেনে নিয়ে গিয়ে হয়তো খেয়ে ফেলেছে।
তিনি নাক থেকে রুমাল সরাতেই ভক করে আরও খানিকটা গন্ধ ঢুকে গেল। তিনি বিশেষ গ্রাহ্য করলেন না। দেয়াশলাইয়ের কাঠি ধরালেন। ঘর খানিকটা আলো হল।
না মরে নি। পিট পিট করে তাকাচ্ছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে দ’দিনের বেশী। টিকবে না। আজ হল তের দিন। আজকাল ডাক্তারগুলির কি রকম বিদ্যা-বুদ্ধি। যে রুগীর দু’দিন বাঁচার কথা সে তের দিন বাঁচে কি করে?
বদরুল আলম সাহেব বললেন, বেঁচে আছো?
ইউনুস বলল, জ্বে আছি।
যা যখন এ্যাই বললাম, তখন কথা বললে না কেন?
ইউনুস জবাব দিল না। সে কথা বলেনি ভয়ে। বদরুল আলম সাহেবকে সে বড় ভয় পায়। তাছাড়া সে এই বাড়ির কামলাও না। সে কাজ করত পুব-পাড়ায়। তারা তাকে রাখতে রাজি না হওয়ায় সবাই মিলে এই বাড়িতে রেখে গেছে। বদরুল আলম সাহেবও রাখতে রাজি হননি। দু’দিনের বেশী টিকবে না শুনে কিছু বলেন নি। তাছাড়া রমজান মাস।
বদরুল আলম সাহেব রাগী গলায় বললেন, ঘরে বাতি দেয় নাই?
দিছিল, নিভ্যা গেছে।
কুপীর বাতি। বাতাসে নিভে যাওয়ারই কথা। বাংলা ঘরে এখন কেউ আসে, কাজেই হারিকেন দেয়া বিপদজনক। চোর এসে নিয়ে যাবে। এই লোক। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, কিছু করতে পারবে না।
ভাত দিয়েছে?
জ্বে দিছে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
ঘর থেকে বেরুবার আগে তিনি আবার কুপী জ্বেলে দিয়ে গেলেন। যতক্ষণ থাকে থাকুক।
মসজিদে সবাই তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিল। তিনি যাওয়া মাত্র তারাবীর নামাজ শুরু হল। নামাজ শেষ হতে তেমন সময় লাগল না কিন্তু দোয়া আর যেন শেষ হতেই চায় না। এক দোয়ায় বাংলা, উর্দু,আরবী, নানান ভাষা। এই মৌলানা সাহেবের চাকরি এখনো স্থায়ী হয়নি। রমজানে মাসে তাঁর কাজকর্ম দেখে তারপর স্থায়ী করা হবে তেমন কথা হয়েছে।
ব্যাটা সে কারণেই দোয়ার মাধ্যমে কাজ কর্ম দেখাচ্ছে। দোয়ার শেষ পর্যায়ে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। বড়ই বিরক্তিকর।
বদরুল আলম সাহেব ঠিক করে রাখলেন আজ মৌলানাকে দু’একটা কথা বলবেন। তিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি। তার পক্ষে এইসব বলা ভাল দেখায় না, তবু বলতে হবে। মানুষের কাজ কর্ম আছে। সারারাত জেগে দোয়া পড়লে তো হবে না। মৌলানা সাহেব দোয়ার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছেন–ওগো পেয়ারা নবীর পেয়ার দোস্ত, তোমার কাছে হাত না তুললে আমরা কার কাছে হাত তুলব? কারণ তুমি নিজেই তো কোরান মজিদে বলেছ–
মারাজ্বাল বাহরাইনি ইয়ালতাক্কিইয়া-ন
অর্থাৎ–তিনি বহমান রেখেছেন দু’টি বিশাল জলরাশিকে …
বাইনহুমা–বারযাখু
অর্থাৎ–তাদের দু’য়ের মাঝে রয়েছে কুদরতী পর্দা …
বদরুল আলম সাহেবের বিরক্তির সীমা রইল না।
আজ রাতের দোয়া মনে হচ্ছে শেষ হবে না।
মৌলানাকে সাবধান করে দিতে হবে। কিছু না বলায় লাই পেয়ে যাচ্ছে।
দোয়া শেষ হল। বদরুল আলম সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, মৌলানা সাহেব আপনার সংগে একটা কথা ছিল। তাঁর গলার স্বরই মৌলানা আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তিনি কি বলবেন তা না শুনেই বলল, আপনের কথা মত আমি গেছিলাম। সে রাজি হয় না। এই কাজ তো জবরদস্তিতে হয় না। যদি বলেন আইজ না হয় আরেকবার যাব।
আপনে কিসের কথা বলতেছেন?
আপনে যে বলছিলেন তওবা করাইতে। তওবা করতে রাজি হয় না।
এতক্ষণ বদরুল আলম সাহেবের মনে পড়ল। মৌলনাকে গত সপ্তাহে বলেছিলেন যেন ইউনুসকে দিয়ে তওবা করানো হয়। একবার তওবা করে ফেললে তিনদিনের ভেতর ঘটনা ঘটে যায়। তাঁর ধারনা ছিল, মৌলানা তওবা করিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে তওবা করায়নি।
তওবা করতে চায় না কেন?
ভয় পায়। মরতে চায় না।
তওবার সাথে বাঁচা-মরার কী সম্পর্ক? জন্মমৃত্যুতে আল্লাহর হাতে। আপনি এখনি চলেন। তওবা করিয়ে দেন। আমি সামনে থাকলে অরাজি হবে না।
জ্বি আচ্ছা।
তাছাড়া এখন মৃত্যু হলে তার জন্যে শুভ। রমজান মাসে মৃত্যু সরাসরি জান্নাতের দরজা–কি বলেন আপনারা।
সবাই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। একজন বলল, এর জন্য আপনি যা করছেন তা বাপ-মাও করত না। বাপ মা’র অধিক করছেন আপনি।
বদরুল আলম সাহেব উদাস গলায় বললেন, আমি তো করার কেউ না। যার করার তিনিই করেন। আমরা হলাম উপলক্ষ। ঐ দিন মিয়া বাড়ির কুদুস সাহেব আসছিলেন। তিনি বললেন, আপনি করছেন কি? অরে অন্য কোনখানে ফালায়ে দিয়ে আসেন। আমি বললাম, রমজান মাসে এই রকম কথা মুখে আনবেন না কুদুস সাহেব।
ইউনুসকে এক ধমক দিতেই সে তওবা করতে রাজি হয়ে গেল। মৌলানা সাহেব বললেন, এইবার আল্লাহপাক তোমাকে আজাব থেকে মুক্তি দিবেন। তাছাড়া তুমি এখন সাত দিনের শিশুর মত পবিত্র। সরাসরি জান্নাতে দাখিল হবে। বুঝতে পারলা?