জে আচ্ছা।
নিজের মনে কাম করে যা। তোর বিয়ের চিন্তা তোর করা লাগবে না। আমি আছি কি জন্যে? একটু সামলে উঠি।
বশির মোল্লা পাঁচ বছরের মাথাতেই সামলে উঠলেন। বেশ ভাল ভাবেই সামলে উঠলেন। স্কুল কমিটির সভাপতি হলেন। উপজেলা ইলেকশনে জিতলেন। রোয়াইল বাজারে বাড়ি বানালেন। গ্রামের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নিয়ে এলেন। তবে গ্রামের বাড়িতে এখন তিনি বেশী থাকেন না। রোয়াইল বাজারেই থাকেন। তার মনের শান্তি ফিরে এসেছে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী আরো একটি মৃত সন্তানের জন্ম দিয়ে পুরোপুরি পোষ মেনে গেছে। পৌষ মাসের এক সন্ধ্যায় বশির মোল্লা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। দিন তিনেক থাকবেন। আজকাল এক নাগারে বেশীদিন গ্রামের বাড়িতে থাকা হয়না। শহরের নানান কাজকর্ম থাকে। কাজকর্ম ফেলে গ্রামের বাড়িতে পড়ে থাকা সম্ভব না। তাছাড়া বেশ কিছু শত্রু তৈরী হয়েছে এরা কখন কি করে বসে, শহরে সেই সুযোগ কম।
বাড়িতে পা দেয়া মাত্র কেরামতের সঙ্গে দেখা হল। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, তুইতো দেখি বুড়ো হয়ে যাচ্ছিসরে কেরামত।
কেরামত মাথা নীচু করে ফেলল। যেন বুড়ো হয়ে যওয়া একটা অপরাধ। বশির মোল্লা বললেন, না এবার তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে হয়–দেখি এই শ্রাবণেই ব্যবস্থা করব। বিয়ে শাদীর জন্যে শ্রাবণ মাস ভাল।
কেরামত ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বে আচ্ছা।
তুই একটা ঘর তুলে ফেল। পুনীর উত্তর পাড়ে যে জায়গাটা আছে ঐ খানে। বাশঝাড় থেকে বাঁশ যা লাগে নে। ঘরটা আগে হউক।
জ্বে আচ্ছা।
বিয়ে একটু বেশী বয়সে হওয়াই ভাল বুঝলি কেরামত এতে মিল মহব্বত ভাল হয়। তুই ঘর তুলে ফেল। উপরে ছন দিয়ে দিস। ছনের টাকা নিয়ে যাস। তোর তো টাকা পাওনাই আছে।
বশির মোল্লা তিন দিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিলেন থাকতে হল সাত দিন। স্কুল কমিটির কিছু সমস্যা ছিল সমস্যা মেটাতে হল। ফুড ফর ওয়ার্ক প্রগ্রামে একশ মন গম এসেছিল সেখানে থেকে সত্তুর মন গমের হিসাব পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটাও ঠিক ঠাক করতে হল। কয়েকটা গ্রাম্য সালিশী করতে হল। দেখতে দেখতে সাতদিন কেটে গেল। শহরে ফেরার দিন তিনি অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে কেরামতের তৈরী ঘর দেখলেন। সে এই সাত দিনে সুন্দর ঘর তুলে ফেলেছে। ঘরের চারপাশে কাঠাল, আম এবং পেয়ারা গাছের চারা লাগিয়েছে।
বশির মোল্লা বললেন, গাছপালা লাগিয়ে তুইতো দেখি হুলুস্থুল করে ফেলেছিস।
কেরামত নিচু গলায় বলল, ফল-ফলান্তির গাছ, পুলাপান বড় হইয়া খাইব। ভাল করেছিস। ভাল। কয়েকটা নারকেল গাছও লাগিয়ে দে।
জে আচ্ছা।
দেখি এই শ্রাবণেই বিয়ে লাগিয়ে দিব।
জ্বে আচ্ছা।
সেই শ্রাবণে কিছু হল না। তার পরের শ্রাবণেও না। বশির মোল্লা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কিডনির অসুখ। চিকিৎসা করাতে সপরিবারে ঢাকা গেলেন।
কেরামতকে বলে গেলেন, সেরে উঠেই বিয়ের ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলবেন। মেয়ে কয়েকটা দেখে রেখেছেন। এদের মধ্যে স্বভাব চরিত্র ভাল দেখে, কাউকে ঠিক করা হবে।
বিয়ে শাদী হুট করে হয় না। লাখ কথার আগে বিয়ে হওয়া ঠিক না। চির জীবনের ব্যাপার।
কেরামত নিচু গলায় বলল, কন্যা স্বাস্থ্যবতী হইলে ভাল হয়। ঘরে কাজকর্ম আছে।
অবশ্যই। অবশ্যই। গ্রামের বউ রোগাপটকা হইলে চলে না। আছে, স্বাস্থ্যবতী মেয়েও সন্ধানে আছে। তুই এই বিষয়ে চিন্তা করিস না। আমি আছি কি জন্যে?
কেরামত চিন্তা করে না। নিজের হাতে লাগানো ফলের গাছগুলিকে যত্ন করে। একটা গাছও যেন না মরে। বিয়ের পর ছেলে পুলে হবে, ফল-ফলান্তির গাছ দরকার। বাজারে জিনিসপত্রের যা দাম। ছেলেপুলেকে ফল-ফলান্তি কিনে। খাওয়ানো সম্ভব না।
কেরামত বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করে। সে জানে না তার বয়স পাঁচপঞ্চাশ পার হয়েছে। এখন তাঁর মাথায় চুল সবই সাদা। বাঁ চোখে ভাল দেখতেও পায় না। গায়ে সেই আগের জোরও নেই। কাজ কর্ম তেমন করতে পারে না। তবু পুরানো অভ্যাসে সারাদিন ক্ষেতে পড়ে থাকে। সন্ধ্যাবেলায় নিজের বাড়িতে এসে অনাগত স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের কথা ভাবতে তার বড় ভাল লাগে।
অয়োময়
বদরুল আলম সাহেব তারাবীর নামাজ পড়তে যাবেন–কি মনে করে যেন বাংলা ঘরে উঁকি দিলেন। ঘর অন্ধকার। অথচ তিনি সন্ধ্যাবেলায় মাগরেবের নামাজে দাঁড়াবার আগেই বলেছিলেন বাংলা ঘরে যেন বাতি দেয়া হয়। এরা কেউ কথা শোনে না। রাগে তাঁর শরীর কাঁপতে লাগল। ইদানীং তাঁর এই সমস্যা হয়েছে, রেগে গেলে শরীর কাঁপে।
বাংলা ঘরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব ব্যাপার। বিকট দুর্গন্ধ। মানুষের শরীর পচে গেলে এমন ভয়াবহ ব্যাপার হয় কে জানত। দুর্গন্ধ নাকের ভিতর দিয়ে ঘ্যাঁৎ করে মাথায় চলে যায়। মাথা ঝিম ঝিম করে। তারপরই বমি বমি ভাব হয়। বদরুল আলম সাহেব রুমাল দিয়ে নাক ঢাকলেন। ঘরে ঢোকার আগেই ঢাকা উচিত ছিল। দেরী হয়ে গেছে। তাঁর মেজাজ আরো খারাপ হল। বাংলা ঘরে ঢোকা উচিত হয়নি। কিছুক্ষণ আগে ভাত খেয়েছেন, খাবার দাবার বমি হয়ে যেতে পারে। তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন এখন ভাত না দিতে। তারাবী পড়ে খাবেন। এটা শুনল না। কেউ আজকাল তার কথা শুনছে না।
তিনি নাকে রুমাল চাপা দিয়েই ডাকলেন–এ্যাই, এ্যাই।
কোন সাড়া পাওয়া গেল না। মরে গেছে নাকি? আশ্চর্য, একটা মানুষ। অর্ধেকটা শরীর পচে গেছে তবু মরার নাম নেই। উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। বলেছে, হাসপাতালে রেখে কি করবেন। বড় জোর দুই দিন, বাড়িতে নিয়ে যান। বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের মাঝখানে আরাম করে মরবে।