আমি বললাম, চিকিৎসা হচ্ছে তো? না-কি এম্নি রেখে দিয়েছেন?
হেডমাষ্টার সাহেব এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। মেয়েটি বিড় বিড় করে আবারো কী যেন বলল। হেডমাষ্টার সাহেব বুঝিয়ে দিলেন-ও জিজ্ঞেস করছে অচিন বৃক্ষ দেখে খুশী হয়েছেন কি-না।
আমি বললাম হয়েছি। খুব খুশী হয়েছি।
মেয়েটি বলল, ফুল ফুটলে আরেকবার আসবেন। ঠিকানা দিয়ে যান। ফুল ফুটলে আপনাকে চিঠি লিখবে।
মেয়েটি এই কথাগুলি বেশ স্পষ্ট করে বলল, আমার বুঝতে কোন অসুবিধা হল না। আমি বললাম, আপনি বিশ্রাম করুন, আমি যাই।
হেডমাষ্টার সাহেব আমাকে এগিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। আমি রাজী হলাম না। এই ভদ্রলোকের এখন উচিত তার স্ত্রীর কাছে থাকা। যত বেশী সময় সে তার স্ত্রীর পাশে থাকবে ততই মঙ্গল। এই মেয়েটির দিনের আলো যে নিভে এসেছে তা যে কেউ বলে দিতে পারে।
আমি এবং ইদরিশ ফিরে যাচ্ছি।
আসার সময় যতটা কষ্ট হয়েছিল ফেরার সময় ততটা হচ্ছে না। আকাশে মেঘ করায় রোদের হাত থেকে রক্ষা হয়েছে। তার উপর ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। ইদরিশের সঙ্গে গল্প করতে করতে এগুচ্ছি।
আমি বললাম, হেডমাষ্টার সাহেব তার স্ত্রীর চিকিৎসা করাচ্ছে না?
করাইতাছে। বিষয় সম্পত্তি যা ছিল সব গেছে পরিবারের পিছনে। অখন বাড়ি ভিটা পর্যন্ত বন্দক।
তাই না-কি?
জ্বি। এই মানুষটা পরিবারের জন্যে পাগল। সারা রাইত ঘুমায় না। স্ত্রীর ধারে বইস্যা থাকে। আর দিনের মধ্যে দশটা চক্কর দেয় অচিন বৃক্ষের কাছে।
কেন?
ফুল ফুটেছে কি না দেখে। অচিন বৃক্ষের ফুল হইল অখন শেষ ভরসা।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।
খেয়া ঘাটের সামনে এসে আমাকে থমকে দাঁড়াতে হল। দেখা গেল হেডমাষ্টার সাহেব ছুটতে ছুটতে আসছেন। ছুটে আসা জনিত পরিশ্রমে খুবই কাহিল হয়ে পড়া একজন মানুষ যার সারা শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। ছুটে আসার কারণ হচ্ছে স্ত্রীর কবিতার খাতা আমাকে দেখাতে ভুলে গিয়েছিলেন। মনে পড়ায় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
আমরা একটা অশ্বথ গাছের ছায়ার নীচে বসলাম। হেডমাষ্টার সাহেবকে খুশী করার জন্যেই দু’নম্বরী খাতার প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ে বললাম, খুব ভাল হয়েছে।
হেডমাষ্টার সাহেবের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বললেন–এখন আর কিছু লিখতে পারে না। শরীরটা বেশী খারাপ।
আমি বললাম, শরীর ভাল হলে আবার লিখবেন।
হেডমাষ্টার সাহেব বললেন, আমিও রেনুরে সেইটাই বলি–অচিন বৃক্ষের ফুল। ফুটারও বেশী বাকি নাই। ফুল ফুটার আগে পচা শ্যাওলার গন্ধ ছাড়ার কথা। গাছ। সেই গন্ধ ছাড়া শুরু করেছে। আর কেউ সেই গন্ধ পায় না। আমি পাই।
আমি গভীর মমতায় ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তিনি ইতস্তত করে বললেন, প্রথম কবিতাটা আরেকবার পড়েন স্যার। প্রথম কবিতাটার একটা ইতিহাস আছে।
কী ইতিহাস?
হেডমাষ্টার সাহেব লাজুল গলায় বললেন, রেনুকে আমি তখন প্রাইভেট পড়াই। একদিন বাড়ির কাজ দিয়েছি। বাড়ির কাজের খাতা আমার হাতে দিয়ে দৌড় দিয়া পালাইল। আর তো আসে না। খাতা খুইল্যা দেখি কবিতা। আমারে নিয়া লেখা। কী সর্বনাশ বলেন দেখি। যদি এই খাতা অন্যের হাতে পড়ত, কি অবস্থা হইত বলেন?
অন্যের হাতে পড়বে কেন? বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে দিবে আপনার হাতেই।
তা ঠিক। রেনুর বুদ্ধির কোন মা-বাপ নাই। কি বুদ্ধি কি বুদ্ধি। তার বাপ মা বিয়ে ঠিক করল–ছেলে পূবালী ব্যাংকের অফিসার। চেহারা সুরত ভাল। ভাল বংশ। পান চিনি হয়ে গেল। রেনু চুপ করে রইল। তারপর একদিন তার মারে গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে বলল, মা তুমি আমারে বিষ জোগাড় কইরা দেও। আমি বিষ খাব। রেনুর মা বললেন, কেন? রেনু বলল–আমার পেটে সন্তান আছে মা। কতবড় মিথ্যা কথা, কিন্তু বলল ঠাণ্ডা গলায়। ঐ বিয়ে ভেঙ্গে গেল। রেনুর মা-বাবা তাড়াহুড়া করে আমার সঙ্গে বিয়ে দিলেন। নিজের ঘরের কথা আপনাকে বলে ফেললাম, আপনি স্যার মনে কিছু নিবেন না।
না–আমি কিছু মনে করি নি।
সবাইরেই বলি। বলতে ভাল লাগে।
হেডমাষ্টারের চোখ চক চক করতে লাগল। আমি বললাম, আপনি ভাববেন না। আপনার স্ত্রী আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন।
তিনি জড়ালো গলায় বললেন, একটু দোয়া করবেন স্যার। ফুলটা যেন তাড়াতাড়ি ফুটে।
পড়ন্ত বেলায় খেয়া নৌকায় উঠলাম। হেডমাষ্টার সাহেব মূর্তির মত ওপারে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেই এক ধরনের প্রতীক্ষার ভঙ্গি আছে। সেই প্রতীক্ষা অচিন বৃক্ষের অচিন ফুলের জন্যে। যে প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে হতদারিদ্র গ্রামের অন্যসব মানুষরাও। এবং কী আশ্চর্য, আমার মত কঠিন নাস্তিকের মধ্যেও সেই প্রতীক্ষার ছায়া। নদী পার হতে হতে আমার কেবলি মনে হচ্ছে-আহা ফুটুক। অচিন বৃক্ষে একটি ফুল হলেও ফুটুক। কত রহস্যময় ঘটনাই তো এ পৃথিবীতে ঘটে। তার সঙ্গে যুক্ত হউক আরো একটি।
হেডমাষ্টার সাহেবও পাড়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন। তার হাতে হাতীর ছবি আঁকা দু’নম্বরী একটা কবিতার খাতা। দূর থেকে কেন জানি তাঁকে অচিন বৃক্ষের মত লাগছে। হাতগুলি যেন অচিন বৃক্ষের শাখা। বাতাস পেয়ে দুলছে।
অপেক্ষা
বশির মোল্লার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে তিনি কোন কিছুতেই রাগ করেন না।
রেগে যাবার মত কোন ঘটনা যখন ঘটে, তিনি সারা চোখে মুখে উদাস এক ধরনের ভাব ফুটিয়ে মৃদু গলায় বলেন–আচ্ছা, আচ্ছা।