অচিন বৃক্ষ
ইদরিশ বলল, ভাইজান ভাল কইরা দেহেন। এর নাম অচিন বৃক্ষ।
বলেই থু করে আমার পায়ের কাছে এক দলা থু থু ফেলল। লোকটির কুৎসিৎ অভ্যাস, প্রতিটি বাক্য দু’বার করে বলে। দ্বিতীয়বার বলার আগে একদলা থু থু ফেলে।
ভাইজান ভাল কইরা দেহেন, এর নাম অচিন বৃক্ষ।
অচিন পাখির কথা গানের মধ্যে প্রায়ই থাকে, আমি অচিন বৃক্ষের কথা এই প্রথম শুনলাম এবং দেখলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে এরা সবাই বৃক্ষ শব্দটা উচ্চারণ করছে শুদ্ধভাবে। তৎসম শব্দের উচ্চারণে কোন গন্ডগোল হচ্ছে না। অচিন বৃক্ষ না বলে অচিন গাছও বলতে পারত, তা বলছে না। সম্ভবত গাছ বললে এর মর্যাদা পুরোপুরি রক্ষিত হয় না।
ইদরিশ বলল, ভাল কইরা দেহেন ভাইজান, ত্রিভুবনে এই বৃক্ষ নাই।
তাই না-কি?
জ্বে। ত্রিভুবনে নাই।
ত্রিভুবনে এই গাছ নাই শুনেও আমি তেমন চমৎকৃত হলাম না। গ্রামের মানুষদের কাছে ত্রিভুবন জায়গাটা খুব বিশাল নয়। এদের ত্রিভুবন হচ্ছে আশে পাশের আট দশটা গ্রাম। হয়ত আশে পাশে এরকম গাছ নেই।
কেমন দেখতাছেন ভাইজান?
ভাল।
এই রকম গাছ আগে কোন দিন দেখছেন?
না।
ইদরিশ বড়ই খুশী হল। থু করে বড় একদলা থু থু ফেলে খুশীর প্রকাশ ঘটাল।
বড়ই আচানক, কি বলেন ভাইজান?
আচানক তো বটেই।
ইদরিশ এবার হেসে ফেলল। পান খাওয়া লাল দাঁত প্রায় সব ক’টা বের হয়ে এল। আমি মনে মনে বললাম, কী যন্ত্রণা! এই অচিন বৃক্ষ দেখার জন্যে আমাকে মাইলের উপরে হাঁটতে হয়েছে। বর্ষা কবলিত গ্রামের দু’মাইল হাঁটা যে কি জিনিস, যারা কোনদিন হাঁটেন নি তারা বুঝতে পারবেন না। জুতা খুলে খালি পায়ে হাঁটতে হয়েছে। হুক ওয়ার্মের জীবাণু যে শরীরে ঢুকে গেছে সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।
গাছটা দেখতাছেন কেমন কন দেহি ভাইজান?
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এরা শুধু গাছ দেখিয়ে খুশী নয়, প্রশংসা সূচক কিছুও শুনতে চায়। আমি কোন বৃক্ষ প্রেমিক নই। সব গাছ আমার কাছে এক রকম মনে হয়। আশে পাশের মানুষদেরই আমি চিনি না, গাছ চিনব কি করে? মানুষজন তাও কথা বলে নিজেদের পরিচিত করার চেষ্টা করে। গাছেরা তেমন কিছুই করে না।
অচিন বৃক্ষ কেমন দেখলেন ভাইজান?
আমি ভাল করে দেখলাম। মাঝারি সাইজের কাঁঠাল গাছের মত উঁচু। পাতাগুলি তেঁতুল গাছের পাতার মত ছোট ছোট। গাছের কাণ্ড পাইন গাছের কাণ্ডের মত মসৃণ। গাছ প্রসঙ্গে কিছু না বললে ভাল দেখায় না বলেই বললাম, ফুল হয়?
ইদরিশ কথা বলার আগেই, পাশে দাঁড়ানো রোগা লোকটা বলল, জ্বে না–ফুল ফুটনের ‘টাইম’ হয় নাই। ‘টাইম’ হইলেই ফুটবে। এই গাছে ফুল আসতে মেলা ‘টাইম’ লাগে।
বয়স কত এই গাছের?
তা ধরেন দুই হাজারের কম না। বেশীও হইতে পারে।
বলেই লোকটা সমর্থনের আশায় চারিদিকে তাকাল। উপস্থিত জনতা অতি দ্রুত মাথা নাড়তে লাগল। যেন এই সময়ে কারো মনেই সন্দেহের লেশ মাত্র নেই। আমি অত্যন্ত বিরক্ত হলাম। গ্রামের লোকজন কথাবর্তা বলার সময় তাল ঠিক রাখতে পারে না। হুট করে বলে দিল দু’হাজার বছর। আর তাতেই সবাই কেমন মাথা নাড়ছে। আমি ইদরিশের দিকে তাকিয়ে বললাম, ইদরিশ মিয়া, গাছ তো দেখা হল, চল যাওয়া যাক।
আমার কথায় মনে হল সবাই খুব অবাক হচ্ছে।
ইদরিশ হতভম্ব গলায় বলল, এখন যাইবেন কি? গাছ তো দেখাই হইল না। তার উপরে, মাষ্টার সাবরে খবর দেওয়া হইছে। আসতাছে।
আমার চারপাশে সতেরো আঠারোজন মানুষ আর একপাল উলঙ্গ শিশু। অচিন বৃক্ষের লাগোয়া বাড়ি থেকে বৌ-ঝিরা উকি দিচ্ছে। একজন এককাদী ডাব পেড়ে নিয়ে এল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, কালো রঙের বিশাল একটা চেয়ারও একজন মাথায় করে আনছে। এই গ্রামের এটাই হয়ত একমাত্র চেয়ার। অচিন বৃক্ষ যারা দেখতে আসেন তাদের সবাইকে এই চেয়ারে বসতে হয়।
অচিন বৃক্ষের নীচে চেয়ার পাতা হল। আমি বসলাম। একজন কে হাত পাখা দিয়ে আমাকে প্রবল বেগে হাওয়া করতে লাগল। স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব চলে এলেন। বয়স অল্প, তবে অল্প বয়সেই গাল টাল ভেঙ্গে একাকার। দেখেই মনে হয় জীবন যুদ্ধে পরাজিত একজন মানুষ। বেঁচে থাকতে হয় বলেই বেঁচে আছে। ছাত্র পড়াচ্ছেন। হেডমাষ্টার সাহেবের নাম মুহম্মদ কুদুস। তাঁর সম্ভবত হাঁপানি আছে। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছেন। নিজেকে সামলে কথা বলতে অনেক সময় লাগল।
স্যারের কি শইল ভাল?
জ্বি ভাল।
আসতে একটু দেরি হইল। মনে কিছু নিবেন না স্যার।
না মনে কিছু নিচ্ছি না।
বিশিষ্ট লোকজন শহর থাইক্যা অচিন বৃক্ষ দেখতে আসে-বড় ভাল লাগে। বিশিষ্ট লোকজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়।
আপনি ভুল করছেন ভাই। আমি বিশিষ্ট কেউ নই।
এই তোমরা স্যারকে হাত পা ধোয়ার পানি দেও নাই, বিষয় কি?
হাত পা ধুয়ে কি হবে? আবার তো কাদা ভাঙতেই হবে।
হেডমাষ্টার সাহেব অত্যন্ত বিস্মিত হলেন, খাওয়া দাওয়া করবেন না? আমার বাড়িতে পাক-শাক হইতেছে। চাইরটা ডাল-ভাত, বিশেষ কিছু নয়। গেরাম দেশে কিছু জোগাড় যন্ত্রও করা যায় না। বিশিষ্ট মেহমানরা আসেন। গত বৎসর ময়মনসিংহের এ ডি সি সাহেব আসছিলেন। এডিসি রেভিন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। অচিন বৃক্ষের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে এক হাজার টাকা দেওয়ার ওয়াদা করলেন।
তাই নাকি? এর জ্বি। অবশ্যি টাকা এখনো পাওয়া যায় নাই। এরা কাজের মানুষ। নানান কাজের চাপে ভুলে গেছেন আর কি। আমাদের মত ত না যে কাজ কর্ম কিছু নাই! এদের শতেক কাজ। তবু ভাবতেছি একটা পত্র দিব। আপনে কি বলেন?