জ্বি না। দরকার হয় নাই। যেটা বলতেছিলাম সেইটা শুনেন, ঘরে দুইটা লাশ। আমি বললাম, খবরদার লাশের গায়ে কেউ হাত দিবা না।
যে রকম আছে সে রকম থাক, আমি নিজে গিয়ে থানায় ওসি সাহেবেরে আনতেছি, ওসি সাহেব আইয়্যা যা করবার করব। থানা আমার বাড়ি থাইক্যা পনের মাইল দূর। পানসি নৌকা নিয়া গেলাম। দারগা সাহেব আর থানা স্টাফের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা নজরানা নিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি বিরাট সমস্যা। দারোগা সাব গিয়েছেন বোয়ালখালী ডাকাতি মামলার তদন্তে। ফিরলেন পরের দিন। তারে নিয়ে আমার বাড়িতে আসতে লাগল তিন দিন।
বর্ষাকাল। গরমের দিন। তিন দিনেই লাশ গেছে পচে। বিকট গন্ধ। দারোগা সাবরে নিয়া কাঁঠাল গাছের কাছে দেখি অদ্ভুদ দৃশ্য। লাখ লাখ লাল পিঁপড়া লাশের শরীরে। মনে হইতেছে মাগীর সারা সইলে লাল চাদর।
মেয়েটারও একই অবস্থা। মুখ হাত পা কিছুই দেখার উপায় নাই। পিঁপড়ায় সব ঢাকা। মাঝে মাঝে সবগুলি পিঁপড়া যখন একসঙ্গে নড়ে, তখন মনে হয় লাল চাদর কেউ যেন ঝাড়া দিল।
ডাক্তার সাহেব তিক্ত গলায় বললেন, আপনি তো দেখি খুবই বদলোক।
জ্বি না, আমার মত টেকা পয়সা যারার থাকে তারা আরো বদ হয়। আমি বদ না। তারপর কি ঘটনা সেইটাই শুনেন–আমি একটা সিগারেট ধরাইলাম। সিগারেটের আগুন ফেলার সাথে সাথে মেয়েটার শরীরের সবগুলি পিঁপড়া নড়ল। মনে হল যেন একটা বড় ঢেউ উঠল। তারপর সবগুলি পিঁপড়া একসঙ্গে মেয়েটারে ছাইড়া মাটিতে নামল। মেয়েটার চোখ মুখ সব খাইয়া ফেলেছে–জায়গায় জায়গায় হাড্ডি বের হয়ে গেছে। দারোগা সাহেব রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরে বললেনমাবুদে এলাহী। তারপর অবাক হয়ে দেখি সবগুলি পিঁপড়া একসঙ্গে আমার দিকে আসতেছে। ভয়ংকর অবস্থা। আমি দৌড় দিয়ে বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে পিঁপড়াগুলি বাইরে আসল। মনে হইল আমারে খুঁজতেছে। সেই থাইক্যা শুরু। যেখানে যাই পিঁপড়া। জনাব আপনার এই ঘরে কি সিগারেট খাওয়া যায়? খাওয়া গেলে একটা সিগারেট খাইতে চাই।
খান।
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।
মকবুল সিগারেট ধরাল। তার মুখ বিষন্ন। সে আনাড়িদের মত ধুয়া ছাড়ছে। খুক খুক করে কাশছে। খানিকটা দম নিয়ে বলল–আমার কাশি ছিল না। এখন কাশি হয়েছে। নাকের ভিতর দিয়া পিঁপড়া ঢুকে গেছে ফুসফুসে। ওরা ঐখানেই বসবাস করে। ক্যামনে বুঝলাম জানেন? কাশির সাথে রক্ত আসে। আর আসে মরা পিঁপড়া।
ডাক্তার সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
মকবুল সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, সিগারেট খাইতেছি যাতে ভাল মত কাশি উঠে। কাশি উঠলে কাশির সাথে পিঁপড়া ও পিঁপড়ার ডিম বাইর হবে। আপনি দেখবেন নিজের চোখে। আমি ঘোষণা দিচ্ছি, যে আমারে পিঁপড়ার হাত থাইক্যা বাঁচাইব তারে আমি নগদ দুই লাখ দিব। আমি বদ লোক হইতে পারি কিন্তু আমি কথার খেলাপ করি না। আমি টাকা সাথে নিয়া আসছি। আপনে আমারে বাঁচান।
ডাক্তার সাহেব কিছু বললেন না। তিনি তার বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপরের কাচের দিকে তাকিয়ে আছেন। মকবুলের বাম হাত টেবিলের উপর। দুই সাড়ি পিঁপড়া টেবিলের দু’প্রান্ত থেকে সেই হাতের দিকে এগুচ্ছে। মকবুলেরও সেই দিকে চোখ পড়ল। সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনের কিছু করা সম্ভব না। ঠিক না ডাক্তার সাব?
হ্যাঁ ঠিক।
আমি জানতাম। আমার মরণ পিঁপড়ার হাতে।
মকবুল মন্ত্র মুগ্ধের মত এগিয়ে আসা পিঁপড়ার সাড়ি দু’টির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ চক চক করছে। সে তার বাঁ-হাত আরেকটু এগিয়ে দিয়ে নীচু গলায় বলল,–নে খা।
পিঁপড়ারা মনে হল একটু থমকে গেল। গা বেয়ে উঠল না–কিছুক্ষণ অনিশ্চয়তায় ভুগল।
মকবুল বলল, নিজ থাইক্যা খাইতে দিলে এরা কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে, সঙ্গে সঙ্গে শরীরে উঠে না। শলা-পরামর্শ করে। এই দেহেন ডাক্তার-সাব উঠতেছে না।
তাই তো দেখছি।
দুই এক মিনিটের ব্যাপার। দুই এক মিনিট শলা পরামর্শ শেষ হইব, তখন শইল্যে উঠা শুরু হইব।
হলও তাই। ডাক্তার সাহেব লক্ষ্য করলেন, পিঁপড়ার দল মকবুলের বাঁ হাতেই উঠতে শুরু করেছে। দু’টি সাড়ি ছাড়াও নতুন এক সাড়ি পিঁপড়া রওনা হয়েছে। এই পিঁপড়াগুলির মুখে ডিম। ডাক্তার সাহেব ভেবে পেলেন না, মুখে ডিম নিয়ে পিঁপড়াগুলি যাচ্ছে কেন? এরা চায় কী? কে তাদের পরিচালিত করছে? কে সেই সূত্রধর?