ডাক্তার সাহেব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। যে লোকটিকে শুরুতে মনে হয়েছিল কথা বলতে পারে না, এখন দেখা যাচ্ছে সে প্রচুর কথা বলতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। গ্রামের লোকজনের প্রাথমিক ইনহিবিশন কেটে গেলে প্রচুর কথা বলে। প্রয়োজনের কথা বাদ দিয়ে অপ্রয়োজনের কথাই বেশী বলে।
চিকিৎসায় কোন ত্রুটি করি নাই জনাব। কেরোসিন তেলে কপূর দিয়ে সেই জিনিস শারীরে মাখছি যদি গন্দে পিঁপড়া না আসে। প্রথম দুই একদিন লাভ হয় তারপর হয় না। পিঁপড়া আসে। এমন জিনিস নাই যে শরীরে মাখি নাই। যে যা বলেছে মাখছি। একজন বলল বাদুরের গু শরীরে মাখলে আরাম হতো। সেই বাদুরের গৃও মাখলাম। এরচেয়ে জনাব আমার মরণ ভাল।
ডাক্তার সাহেব তার এাসিসটেন্টের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাসায় টিলিফোন করে দাও যে আমি একটা ঝামেলায় আটকে পড়েছি। আসতে দেরী হবে। আর আমাদের চা দাও।
আপনি চা খান তো?
জ্বি চা খাই।
চা খেতে খেতে বলুন কী ভাবে এটা শুরু হল, প্রথম কখন পিঁপড়া আপনার দিকে আকৃষ্ট হল।
একটু গোপনে বলতে চাই জনাব।
গোপনে বলার ব্যাপার আছে কি?
জ্বি আছে।
বেশ গোপনেই বলবেন। আগে চা খান।
লোকটি চা খেল নিঃশব্দে। চা খাবার সময় একটি কথাও বলল না। তার কথা বলার ইচ্ছা সম্ভবত ঢেউয়ের মত আসে। ঢেউ যখন আসে তখন প্রচুর বক বক করে, ঢেউ থেমে গেলে চুপ চাপ হয়ে যায়। তখন কথা বলে তার সঙ্গী। এখন সঙ্গীই কথা বলছে–
ডাক্তার সাব, সবচে বেশী ফল হয়েছে যে চিকিৎসায় সেইটাই তো বলা হয় নাই। মকবুল ভাই, ঐ চিকিৎসার কথা বলেন।
তুমি বল।
এই চিকিৎসা মকবুল ভাই নিজেই বাইর করছে। বিষে বিষক্ষয় চিকিৎসা। গুড়ের গন্ধে পিঁপড়া সবচে বেশী আসে। মকবুল ভাই করলেন কি, সারা শইলে গুড় মাখলেন। এতে লাভ হইছিল। সাতদিন কোন পিঁপড়া আসে নাই।
মকবুল গম্ভীর গলায় বলল, সাতদিন না পাঁচদিন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, পাঁচদিন পরে আবার পিঁপড়া আসা শুরু হল?
জি।
পিঁপড়ার হাত থেকে বাঁচার জন্যে মনে হয় অনেক কিছু করেছেন।
জি। নদীর মাঝখানে নৌকা নিয়া কয়েকদিন ছিলাম। তিন দিন আরামে ছিলাম। চাইর দিনের দিন পিঁপড়া ধরল।
সেখানে পিঁপড়া গেল কি ভাবে?
জানি না জনাব। অভিশাপ।
কিসের অভিশাপ?
আপনারে গোপনে বলতে চাই।
ডাক্তার সাহেব গোপনে বলার ব্যবস্থা করলেন। পুরু ব্যাপারটায় তিনি এখন উৎসাহ পেতে শুরু করেছেন। শালীর জন্মদিনের কথা মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে। খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছেন। এই পর্যন্তই। কোন রুগীর ব্যাপারে এ জাতীয় কৌতূহল তিনি এর আগে বোধ করেন নি। অবশ্যি এই লোকটিকে রুগী বলতেও বাধছে। কাউকে পিঁপড়া ছেকে ধরে এটা নিশ্চয়ই কোন রোগ ব্যধির পর্যায়ে ফেলা যাবে না।
ঘর থেকে সবাইকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। মকবুলের সঙ্গীও নেই। দরজা ভেজানো। মকবুল নীচু গলায় কথা শুরু করল
জনাব, আপনেরে আমি আগেই বলছি আমি টাকা পয়সা ওয়ালা লোক। আমাদের টাকা পয়সা আইজ কাইলের না। ব্রিটিশ আমলে আমার দাদাজান পাকা দালান দেন। দাদাজানের দুইটা হাতী ছিল একটার নাম ময়না অন্যটার নাম সুরভী। দুইটাই মাদী হাতী।
ঐ প্রসঙ্গ থাক, আপনার পিঁপড়ার প্রসঙ্গে আসুন।
আসতেছি। আমি পিতা মাতার একমাত্র সন্তান। বিরাট ভূ-সম্পত্তির মালিক। টাকা পয়সা, ক্ষমতা এইসব জিনিস বেশী থাকলে মানুষের স্বভাব চরিত্র ঠিক থাকে না। আমারো ঠিক ছিল না। আপনারা যারে চরিত্র দোষ বলেন তাই হইল। পনের ষোল বছর বয়সেই। বিরাট বাড়ি–সুন্দরী মেয়েছেলের অভাব ছিল না। দাসী বাদি ছিল। দরিদ্র আত্মীয় স্বজনের মেয়ে বউরা ছিল।
আমারে একটা কঠিন কথা বলার বা শাসন করার কেউ ছিল না। আমার মা অবশ্য জীবিত ছিলেন। কেউ কেউ তার কাছে বিচার নিয়ে গেছে। লাভ হয় নাই। উল্টা আমার ধমক খাইছে।
আপনি বিয়ে করেন নি?
জ্বি বিবাহ করেছি। বিবাহ করব না কেন? দুটি বিবাহ করেছি। সন্তানাদি আছে। স্বভাব নষ্ট হইল বিয়ে সাদী করলেও ফয়দা হয় না। মেয়েছেলে দেখলেই…
আপনি আসল জায়গায় আসুন। আজে বাজে কথা বলে বেশী সময় নষ্ট করছেন।
জ্বি আসতেছি। বছর পাঁচেক আগে আমার দূর সম্পর্কীয় এক বোনের মেয়ের উপর আমার চোখ পড়ল। চইদ্দ পনের বছর বয়স। গায়ের রঙ একটু ময়লা, কিন্তু স্বাস্থ্য ভাল। আমার চরিত্র তো কারো অজানা না। মেয়ের মা মেয়েকে আগলায়ে রাখে। খুবই বজ্জাত মা, মেয়েকে নিয়ে আমার মার ঘরে মেঝেতে ঘুমায়। এত কিছু কইরাও লাভ হইল না। এক রাতে ঘটনা ঘটে গেল।
কি বললেন, ঘটনা ঘটে গেল?
জ্বি।
আশ্চর্য ব্যাপার। আপনি যে ভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে খুবই তুচ্ছ একটা ব্যাপার।
জিনিসটা তুচ্ছই। কিছুই না। হে হে হে।
হাসবেন না। হাসির কোন ব্যাপার না।
জ্বি আচ্ছা। তারপর কি হল–ঐ বজ্জাত মা সেই রাইতেই মেয়েটারে ইঁদুর মারা বিষ খাওয়াইয়া দিল। আর নিজে একটা দড়ি নিয়ে বাড়ির পিছনে একটা। আমগাছে ফাঁস নিল। আমারে বিপদে ফেলার চেষ্টা। আর কিছু না। মাগী চূড়ান্ত বজ্জাত। আমি চিন্তায় পড়লাম। দুইটা মিত্যু সোজা কথা না। থানা পুলিশ হবে। পুলিশ তো এই জিনিসটাই চায়। এরা বলবে খুন করা হয়েছে।
আপনি খুন করেন নি?
আরে না। খুন করব কি জন্যে। আর যদি খুনের দরকারও হয় নিজের ঘরে খুন করব? কাউরে খুন করতে হইলে জায়গার অভাব আছে? খুন করতে হয় নদীর উপরে। রক্ত ধুইয়ে বয়ে যায়। তারপর লাশ বস্তার ভিতর বইরা চুন মাখায়ে চার পাঁচটা ইট বস্তার ভিতর দিয়ে বিলে ফালায়ে দিতে হয়। এই জন্মের নিশ্চিন্ত। কোনো সম্পুদ্ধির পুত কিছু জানব না। যা আপনি খুনও করেছেন?