বিনীত
আপনার একান্ত অনুগত ছাত্র
আবুল কাশেম।
ব্লুষ্টার ফার্মেসী। নান্দাইল। কেন্দুয়া।
ডাক্তার সাহেব রুগীর দিকে তাকালেন। রুগী পাথরের মত মুখ করে বসে। আছে। গায়ে ফতুয়া ধরনের জামা। পরনে লুঙ্গী। অত্যন্ত ধনবান ব্যক্তির পোষাক নয়।
ডাক্তার সাহেব কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। কিছু একটা বলতে হয় আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই জাতীয় উদ্ভট যন্ত্রণার কোন মানে হয়?
পিঁপড়া কামড়ায় আপনাকে?
জ্বি স্যার। কোন এক জায়গায় বসে থাকলেই পিঁপড়া এসে ধরে।
নুরুল আফসার সাহেব একবার ভাবলেন বলবেন, আপনি কি রসোগোল্লা নাকি যে পিঁপড়া ছেকে ধরবে? শেষ পর্যন্ত বললেন না।
বড় কষ্টে আছি স্যার। যদি ভাল করে দেন সারাজীবন কেনা গোলাম হইয়া থাকব। টাকা পয়সা খরচ কোন ব্যাপার না, স্যার। টাকা যা লাগে লাগুক।
আপনার কি অনেক টাকা?
জ্বি স্যার।
কী পরিমাণ টাকা আছে?
রুগী কোন জবাব দিল না। রুগীর সঙ্গী বলল, মকুবল ভাইয়ের কাছে টেকা পয়সা কোন ব্যাপার না। লাখ দুই লাখ উনার হাতের ময়লা।
নূরুল আফসার সাহেব এই প্রথম খানিকটা কৌতূহলী হলেন। লাখ টাকা ফতুয়া গায়ে লুঙ্গী পরা এই লোকটির হাতের ময়লা এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তিনি নিজেও ধনবান ব্যক্তি। ফিক্সড ডিপোজিটে তাঁর এগারো লাখ টাকার মত আছে। এই টাকা সঞ্চয় করতে গিয়ে জীবন পানি করে দিতে হয়েছে। ভোর ছ’টা থেকে রাত বারোটা এক মুহূর্তের বিশ্রাম নেই।
একমাত্র ছুটির দিন শুক্রবারটাও তিনি কাজে লাগান। সকালের ফ্লাইটে চিটাগাং যান লাষ্ট ফ্লাইটে ফিরে আসেন। ওখানকার একটা ক্লিনিকে বসেন। ঐ ক্লিনিকের তিনি কনসালটিং ফিজিসিয়ান। আর এই লোককে দেখে তো মনে হয় না সে কোন কাজ কর্ম করে। নির্বোধের মত এই লোক এত টাকা করে কী করে? নুরুল আফসার সাহেবের মেজাজ খারাপ হয় গেল।
মকবুল ক্ষীণ স্বরে বলল, রোগটা যদি সারায়ে দেন।
এটা কোন রোগ না। আমি এমন কোন রোগের কথা জানি না যে রোগে দুনিয়ার পিঁপড়া এসে কামড়ায়। অসুখটা আপনার মনে। আমি সাইকিয়াট্রিষ্টের ঠিকানা লিখে দিচ্ছি — তাঁর সঙ্গে কথা বলুন। আপনার যে সমস্যা এই সমসার সমাধান আমার কাছে নেই।
নূরুল আফসার সাহেব বাক্যটা পুরোপুরি শেষ করলেন না। কারণ একটা অদ্ভুত দৃশ্যে তাঁর চোখ আটকে গেল। তিনি দেখলেন, টেবিলের উপর রাখা মকবুলের ডান হাতের দিকে এক সাড়ি লাল পিঁপড়া এগুচ্ছে। পিঁপড়ারা সচরাচর এক লাইনে চলে, এরা তিনটি লাইন করে এগুচ্ছে।
ডাক্তার সাহেবের দৃষ্টি লক্ষ্য করে মকবুলও তাকাল পিঁপড়ার সাড়ির দিকে। সে কিছু বলল না, বা হাতও সরিয়ে নিল না।
নূরুল আফসার সাহেব বললেন, এই পিঁপড়াগুলি কি আপনার দিকে আসছে?
জ্বি স্যার।
বলেন কী?
পায়েও পিঁপড়া ধরেছে। এক জায়গায় বেশীক্ষণ বসতে পারি না স্যার।
নূরুল আফসার সাহেব কাছে এগিয়ে এলেন উঁচু হয়ে বসলেন। সত্যি সত্যি দু’সাড়ি পিঁপড়া লোকটির পার দিকে এগুচ্ছে।
মকবুল সাহেব।
জ্বি স্যার।
আমার একটা জরুরী কাজ আছে চলে যেতে হচ্ছে। আপনি কি কাল একবার আসবেন।
অবশ্যই আসব। যার কাছে যাইতে বলেন যাব। বড় কষ্টে আছি স্যার। রাত্রে ঘুমাইতে পারি না। নাকের ভিতর দিয়ে পিঁপড়া ঢুকে যায়।
আপনি কাল আসুন। কাল কথা বলব।
জি আচ্ছা।
মকবুল উঠে দাঁড়াল। পর মুহূর্তেই যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্যে নূরুল আফসার সাহেব মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর কাছে মনে হল মকবুল কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। চিন্তা ও বিচার শক্তি পুরোপুরি লোপ পেয়েছে। তিনি দেখলেন মকবুল হিংস্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে, পা ঘসে ঘসে পিঁপড়া মারার চেষ্টা করছে। এক পর্যায় সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলে, দু’হাতে পিষে ফেলল পিঁপড়ার সাড়ি। মকবুলের মুখ ঘামে চট চট করছে চোখের তারা ঈষৎ লালাভ। মুখে হিস হিস শব্দ করছে এবং নীচু গলায় বলছে হারামজাদ, হারামজাদ।
তার সঙ্গী কিছুই বলছে না। মাথা নীচু করে সিগারেটের কাঠি দিয়ে দাঁত খুচাচ্ছে। তার ভাবভক্তি থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, এ জাতীয় ঘটনার সঙ্গে সে পরিচিত। এই ঘটনায় সে অস্বাভাবিক কিছু দেখছে না।
নূরুল আফসার সাহেব মলীর জন্মদিনের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেলেন। রুগীর দিকে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর দু’জন এ্যসিসটেন্টও ছুটে এসেছে। তারা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে মুখে বিস্ময়ের চেয়ে ভয় বেশী।
মকবুল হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেল। নীচু গলায় বলল, স্যার মনে কিছু নিবেন না। এই পিঁপড়ার ঝাঁক আমার জেবন শেষ কইরা দিছে। হারামজাদা পিঁপড়া। এক গেলাস ঠাণ্ডা পানি দিবেন?
ডাক্তার সাহেবের এ্যসিসটেন্ট অতি দ্রুত ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে নিয়ে এল। একজন ভয়ংকর পাগলের পাগলামী হঠাৎ থেমে গেছে এই আনন্দেই সে আনন্দিত।
মকবুল পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বসে রইল পানি মুখে দিল না। মাথা নীচু করে বিড় বিড় করে বলল, যেখানে যাই সেইখানে পিঁপড়া, কি করব কন। যে খাটে ঘুমাই সেই খাটের পায়ার নীচে বিরাট বিরাট ঘটির সরা। সরা ভর্তি পানি। তাতেও লাভ হয় না।
লাভ হয় না?
জ্বি না। ক্যামনে ক্যামনে জানি বিছানায় পিঁপড়া উঠে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিছানার চাদর বদলাতে হয়।
বলেন কি?
সত্যি কথা বলতেছি জনাব। এক বর্ণ মিথ্যা না। যদি মিথ্যা হয় তা হইলে যেন আমার শরীরে কষ্ট হয়। আমি জনাব এক জায়গায় বেশীক্ষণ থাকতেও পারি না। জায়গা বদল করতে হয়। আমার জীবন শেষ।