কিংবা দৃশ্যটা আরো হৃদয়স্পর্শী হয় যদি শেষ দৃশ্যটি এরকম হয়–মতি মিয়ার বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে পড়েছে, একজন শুধু জেগে আছে। মতি মিয়া গোশতের শেষ টুকরাটি মুখে তুলে দিয়ে থমকে যাবে। মুখে না দিয়ে এগিয়ে দেবে শিশুটির দিকে। সবাই তখন চেঁচিয়ে উঠকে-কর কি কর কি? বাজিতে হেরে যাচ্ছ তো। এটাও খাও।
মতি মিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলবে–হারলে হারব।
আমি জানি বাস্তবে তা হবে না। সকাল দশটা হোক, এগারোটা হোক মতি মিয়া খাওয়া শেষ করবে। কোন দিকে ফিরেও তাকাবে না। এত কিছু দেখলে খাদক হওয়া যায় না।
পিঁপড়া
আপনার অসুখটা কী বলুন?
রুগী কিছু বলল না,পাশে বসে থাকা সঙ্গীর দিকে তাকাল।
ডাক্তার নূরুল আফসার, এমআরসিপি, ডিপিএস,অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তার বিরক্তির তিনটি কারণ আছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, আটটা বেজে গেছে–রুগী দেখা বন্ধ করে বাসায় যেতে হবে। আজ তার শ্যালিকার জন্মদিন। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, গ্রাম থেকে আসা রুগী তিনি পছন্দ করেন না এরা হয় বেশী কথা বলে, নয় একেবারেই কথা বলে না। ভিজিটের সময় হলে দর দাম করার চেষ্টা করে। হাত কচলে মুখে তেলতেলে ভাব ফুটিয়ে বলে–কিছু কম করা যায় না ডাক্তার সাব। গরীব মানুষ।
আজকের এই রুগীকে অপছন্দ করার তৃতীয় কারণটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবু নুরুল আফসার সাহেবের কাছে এই কারণটিই প্রধান বলে বোধ হচ্ছে। লোকটির চেহারা নির্বোধের মত। এই ধরনের লোক নিজের অসুখটাও ঠিক মত বলতে পারে না। অন্য একজনের সাহায্য লাগে।
বলুন, তাড়াতাড়ি বলুল। আমার অন্য কাজ আছে।
লোকটি কিছু বলল না। গলা খাকারী দিয়ে সঙ্গীর দিকে তাকাল। ভাবখানা এরকম যে অসুখের কথা-বার্তা সঙ্গীটিই বলবে। সে-ও কিছু বলছে না। ডাক্তার নূরুল আফসার হাত ঘড়ির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন, গরু ছাগল তার কী অসুখ বলতে পারে না। তাদের অসুখ অনুমানে ধরতে হয়। আপনি তো আর গরু ছাগল না। চুপ করে আছেন কেন? নাম কি আপনার?
রুগী কিছু বলল না। তার সঙ্গী বলল, উনার নাম মকবুল। মোহম্মদ মকবুল হোসেন ভূঁইয়া।
নামটাও অন্য আরেকজনকে বলে দিতে হচ্ছে। আপনি কি কথা বলতে পারেন, না–পারেন না?
পারি।
কী নাম আপনার?
মোহম্মদ মকবুল হোসেন ভূঁইয়া।
বয়স কত?
বায়ান্ন।
আপনার সমস্যাটা কি? রুগী মাথা নীচু করে ফেলল। নূরুল আফসার সাহেবের ধারণা হল অস্বস্তিকর কোন অসুখ, যার বিবরণ সরাসরি দেয়া মুশকিল।
আর তো সময় দিতে পারব না। আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। যদি কিছু বলার থাকে এক্ষুনি বলবেন। বলার না থাকলে চলে যান।
রুগী আবার গলা খাকাড়ি দিল।
তার সঙ্গী বলল, উনার অসুখ কিছু নাই।
অসুখ কিছু নেই এসেছেন কেন?
উনারে পিঁপড়ায় কামড়ায়।
কী বললেন?
পিঁপড়ায় কামড়ায়। পিপীলিকা।
ডাক্তারী করতে গেলে অধৈর্য হওয়া চলে না। রুগীদের সঙ্গে রাগারাগিও করা চলে না। এতে পশার কমে যায়। রোগের বিবরণ শুনে বিস্মিত হওয়াও পুরোপুরি নিষিদ্ধ। রোগের ধরন-ধারন যতই অদ্ভুত হোক ভান করতে হয় যে, এ জাতীয় রোগের কথা তিনি শুনেছেন এবং চিকিৎসা করে আরাম করেছেন। নূরুল আফসার সাহেব ডাক্তারীর এই সব সহজ নিয়ম কানুন নিষ্ঠার সঙ্গে মানেন। আজ মানতে পারলেন না। ধমকের স্বরে বললেন, পিঁপড়ায় কামড়ায় মানে?
রুগী পকেটে হাত দিয়ে একটুকরা কাগজ বের করে বলল, চিঠিটা পড়েন। চিঠির মধ্যে সব লেখা আছে।
কার চিঠি?
কাশেম সাহেব।
কাশেম সাহেব কে?
এমবিবিএস ডাক্তার। আমাদের অঞ্চলের। খুব ভাল ডাক্তার। উনি আপনার কাছে আমারে পাঠাইছেন। বলছেন নাম বললে আপনি চিনবেন। উনি আপনের ছাত্র।
নূরুল আফসার সাহেব কাশেম নামের কোন ছাত্রের নাম মনে করতে পারলেন। কাশেম বহুল প্রচলিত নামের একটি। ক্লাসের প্রতি বছরই দু’একজন কাশেম থাকে। এ কোন কাশেম কে জানে।
স্যার চিনেছেন?
চিনি না বলাটা ঠিক হবে না। পুরানো ছাত্ররা রুগী পাঠায়। এদেরকে খুশী রাখা দরকার। কাজেই আফসার সাহেব শুকনো হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ চিনেছি। কি। লিখেছে দেখি।
উনি স্যার আপনাকে সালাম দিয়েছেন।
আচ্ছা ঠিক আছে। দেখি চিঠিটা দেখি।
চিঠি দেখে ডাক্তার সাহেবের ভ্রু কুঞ্চিত হল। বাঙ্গালী জাতির সবচে দোষ হল এরা কোন জিনিষ সংক্ষেপে করতে পারে না। দুই পাতার এক চিঠি কেঁদে বসেছে। তিনি পড়লেন।
পরম শ্রদ্ধেয় স্যার,
আমার সালাম জানবেন। আমি সেভেন্টি থ্রি ব্যাচের ছাত্র। আপনি আমাদের ফার্মাকোলজী পড়াতেন। আপনার বিষয়ে আমি সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিলাম। সেই উপলক্ষে আপনি আপনার বাসায় আমাকে চায়ের দাওয়াত করেছিলেন।
আশা করি আপনার মনে পড়েছে। যাই হোক, আমি মকবুল সাহেবকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। মকবুল এই অঞ্চলের একজন অত্যন্ত ধনবান ব্যক্তি। সে বছর চারেক ধরে অদ্ভুত এক ব্যাধিতে ভুগছে। একে ব্যাধি বলা যাবে না কিন্তু অন্য কোন নামও আমি পাচ্ছি না। ব্যাপারটা হচ্ছে তাকে সব সময় পিঁপড়ায় কামড়ায়।
বুঝতে পারছি বিষয়টা আপনার কাছে খুবই হাস্যকর মনে হচ্ছে। শুরুতে আমার কাছেও মনে হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম এটা এক ধরনের মানসিক ব্যধি। বর্তমানে আমার সেই ধারণা পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে। আমি নিজে লক্ষ করেছি মকবুল সাহেব কোথাও বসলেই সাড়ি বেঁধে পিঁপড়া তার কাছে। আসতে থাকে।
পীর-ফকির, তাবিজ, ঝাড়-ফুক জাতীয় আধি ভৌতিক চিকিৎসা সবই করানো হয়েছে। কোন লাভ হয়নি। আমি কোন উপায় না দেখে আপনার কাছে পাঠালাম। অপনি দয়া করে ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবেন না।